রবিবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

পাঠকের পাঠ্যাভাসের প্রয়োজনীয়তা


‘ধুর! কি যে লিখছে, বোঝাই যায় না!’ এরকম কথা আমি হরহামেশাই শুনি অনেক পাঠকের মুখ থেকে। অবশ্য যেদেশের গড় সাহিত্য আস্বাদনের সর্বোচ্চ নিদর্শন কতগুলো হাতে গোনা জনপ্রিয় রচনাবলিতে, সে দেশের বেশিরভাগ পাঠকের কাছ থেকে এরকম দোষারোপ করাটাই স্বাভাবিক।
পা দিয়ে ঠকে যে, তিনিই নাকি পাঠক। তবে একথাও ঠিক যে, পাঠকই লেখকের সরাসরি প্রাথমিক মূল্যায়নকারী। অবশ্য আমাদের দেশে স্কুল-কলেজের সাহিত্যের ক্লাসগুলো শুধু পড়া আদায় করাতেই সীমাবদ্ধ, পড়ানোতে নয়। তাই কোন রচনার নামকরণের সার্থকতা কিংবা মর্মবাণী শিক্ষার্থীরা আত্মস্থ করতে পারে না। বরং বিভিন্ন গাইডে অন্যের মতামত তারা তোতাপাখির মত মুখস্থ করে তা পরীক্ষার খাতায় লেখাতে পারদর্শী হয়। ফলে সাহিত্যের মত একটি নান্দনিক বিষয়ে মানুষের আগ্রহ কমতে কমতে এমন হয় যে, উচ্চশিক্ষায় যারা সাহিত্য নিয়ে পড়ে তারা বেশিরভাগই বাধ্য হয়েই তা গিলতে বাধ্য হয়।
শুনেছি প্লোটো এবং তাঁর প্রিয় শিষ্য এরিস্টটল নাকি দুধরনের লোকের জন্য দুভাবে বই লিখেছিলেন। অপেক্ষাকৃত কম বোঝা মানুষের জন্য সহজভাবে আর অপেক্ষাকৃত ভালো বোঝা মানুষের জন্য কঠিনভাবে তাঁরা লিপিবদ্ধ করেছেন দার্শনিক তত্ত্বসমূহ। কিন্তু কালের বিবর্তনে এরিস্টটলের সহজভাবে লেখা রচনাগুলোই টিকে যায়। অপরদিকে নিজের প্রস্তাবিত আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের প্রবেশাধিকার না রাখলেও, জাতকবি প্লেটোর কঠিনভাবে লেখাটিই হয়ে ওঠে কালোত্তীর্ণ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘোষণা করেছেন, ‘সত্য যে কঠিন, / কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, / সে কখনো করে না বঞ্চনা।’ আবার কবিদের কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘কিছুই সহজ নয়’ কবিতায় গেয়ে ওঠেন, ‘সহজ আনন্দ ছিল কিসে, মনেও পড়ে না। / জীবনের দেনা শুধু বাড়ে চক্রবৃদ্ধি হারে; / শুধিতে পারি না ঋণ, বুঝি সহজ ছিল না রাত্রি, / ছিল না সহজ কোনদিন।’
বস্তুত, আমরা যা পারি না তাই আমাদের কাছে কঠিন। ব্যাপারটি আপেক্ষিক এবং ব্যবহারকারীভেদে পরিবর্তনশীল। ধরুন একজন সব্যসাচী ব্যক্তি সবকিছুই ভালোভাবে করতে পারেন কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাইসাইকেল চালাতে পারেন না। তবে, তার কাছে ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর চেয়ে বাইসাইকেল চালানো বেশি কঠিন বলে মনে হবে।
তাই, যখন কাউকে অবলীলায় রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দ দাশের নেতিবাচক সমালোচনা করে তখন আমারও যীশু খ্রিস্টের মত মনে হয়, 'ঈশ্বর, ইহাদিগকে (যারা তাকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে) ক্ষমা করো; কেননা ইহারা কি করিতেছে তাহা জানে না।' আসলে এই অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী জ্ঞানসম্পন্ন লোকজনের নেতিবাচক মূল্যায়ন জীবনানন্দ কিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক মূল্য কোনভাবেই কমাতে পারে না। তবে ধারাবাহিক অজনপ্রিয়তা অনেক সময় জীবনানন্দ বা ভ্যান গগের মত ধারা তৈরিকারী মহান শিল্পীকেও ঠেলে দিয়েছে হতাশার তলানীতে। তাই, দার্শনিক কান্টের মত আমারও মাঝে মাঝে মনে হয় যে, মানুষকে অল্প ভুলেও বেশ শাস্তি দেওয়া উচিৎ।
মূলত, জনপ্রিয় হওয়া মানে বেশিরভাগ মানুষের সাথে মতের মিল হওয়া। কিন্তু যখন আপনি সমাজে বা রাষ্ট্রে নতুন কিছু আনছেন তখন তা বর্তমান লোকজনের চিন্তার সাথে না মেলাই স্বাভাবিক। তাই যুগ পরিবর্তনকারী শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের অজনপ্রিয় হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। তাই হাওয়ার বিপরীত তালে চলে তারা হন গণতান্ত্রিক ভুলের বলি। অনেক ক্ষেত্রে অনেকে হন নির্বাসিত বা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। এর উদাহরণ স্বয়ং সক্রেটিস।
তাই, বর্তমানে সহজ আর জনপ্রিয়কে এক কাতারে দাঁড় করানো যায়। কিন্তু, হুমায়ুন আজাদের মতে, ‘জনপ্রিয়তা হচ্ছে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি। অনেকেই আজকাল জনপ্রিয়তার পথে নেমে যাচ্ছে।’ তাই, যা কিছু সহজ না, তাকে হুট করে খারাপ বলার অভ্যাস পরিত্যাগ করুন। লেখকের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই, পাঠক হিসেবে আপনি আপনার জ্ঞানের পরিধি বাড়ান, দেখবেন কঠিনের মাঝেও পুষ্প ফুটছে অহর্নিশ। নচেৎ, আপনাকে ঘুরতে হবে গড় পাঠক হয়ে সাধারণ বইয়ের সাময়িক জ্ঞানের বৃত্তে।
শেষ করবো সুনীলের নীরাকে দিয়ে। নীরা একদিন আমাকে বললো, ‘তোমার জীবনে দরকার সহজ-সরল এক মেয়ে, যে কঠিন কথা শুধুই শুনে যাবে। তাহলে কোন দাম্পত্য দ্বন্দ্ব হবে না।’ আমি স্মিত হেসে বলি, ‘দ্বন্দ্ব ছাড়া গতি হয় না, গতি ছাড়া দ্বন্দ্ব হয় না।’