মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০১৯

'বিনিময়’ উন্নয়নে ৬ দফা


সাধারণভাবে বলা হয়, রাজধানী ঢাকা হতে যতই উত্তরে যাওয়া হয় ততই মানুষ সরল থেকে সরলতর হয় আর যতই দক্ষিণ দিকে যাওয়া হয় ততই চালাক লোকের দেখা মেলে। ভৌগোলিকভাবে ধনবাড়ী উপজেলা ঢাকা বিভাগের সর্ব উত্তরের উপজেলা। তাই, এখানকার মানুষজন বেশিরভাগই সহজ-সরল। তবে, সহজ-সরলতার জন্য উত্তরবঙ্গের মানুষজনকে এমনকি আমরাও ‘মফিজ’ বলতে দ্বিধা করি না। যদিও জন্ম দিয়ে মানুষকে বিচার করা উপমহাদেশীয় আদি বদ অভ্যাস, উপরন্তু অতীত গর্বে মজে বর্তমানকে অস্বীকার করাও এক আভিজাত্য হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু, যাদের আমরা ‘মফিজ’ সম্বোধনে অভ্যস্ত, তাদের গণপরিবহনের অবস্থা অবলোকন করেছেন কি? যদি মনোযোগ দিয়ে দেখেই থাকেন তবে আমাদের গণপরিবহনের সাথে তুলনা করুন। আশা করি, তথাকথিত ‘মফিজ’দের গণপরিবহনের অবস্থা যদি ‘সড়ক পথে বিমানের ছোঁয়া’ হয়, তবে তার চেয়ে কয়েক গুণ বাজে সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট আমাদের উপাধি কি হতে পারে, একবার নিজে নিজেই চিন্তা করুন।
আগেভাগেই বলে নেই, আমি বিনিময়ের নিন্দুক তো নইই বরং শুভাকাঙ্ক্ষী। শিক্ষার উদ্দেশ্যে কসমোপলিটন মেগাসিটি ঢাকার রাস্তায় যখন ‘বিনিময়’ বাস দেখি, তখন নিজের অজান্তেই ‘বিদেশে নিজ এলাকার কুকুর দেখলেও নাকি আপন মনে হয়’ কথাটির সত্যতা হাড়ে হাড়ে টের পাই। কিন্তু, নিজ এলাকার ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা যখন একযোগে এর তীব্র সমালোচনা করে, তখন আমার নিজেরই খুব কষ্ট হয়। তাই, বিনিময়কে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক আন্তঃজেলা গণপরিবহনে পরিণত করার জন্য আমার এই কি-বোর্ডে হাত চালানো। ‘আমরা ধনবাড়ীবাসী’ নামক ধনবাড়ীর সবচেয়ে বেশি মানুষের ভার্চুয়াল কোলাহলমুখর ফেসবুক গ্রুপে ‘বিনিময়’ সংস্কার নিয়ে খোলা পোলের ভোট অনুযায়ী নিচে ‘বিনিময়’ সংস্কারের ৬ দফা প্রস্তাবনা দেওয়া হলো। সুতরাং, এটি শুধু আমার ব্যক্তিগত মতামত নয় বরং এ অঞ্চলের অনেকের চাহিদার সম্মিলিত প্রতিফলন।
১। দূরত্ব (ধনবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল পর্যন্ত ১৫০ কিমি) ও তেলের মূল্য অনুযায়ী একটি দীর্ঘস্থায়ী ভাড়া স্থির করা, যা ঈদ কিংবা অন্যান্য উৎসব বা লম্বা ছুটির পর অযৌক্তিকভাবে বাড়বে না। স্বজনপ্রীতি কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তি অনুযায়ীও এটি যেন নড়চড় না হয় তার জন্য কম্পিউটারাইজড টিকেট কাটার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বর্তমানে ধনবাড়ীর মানুষের যে ক্রয়ক্ষমতা, তাতে তারা বাস ভাড়া বাড়লেও ভ্রমণ করবে, কিন্তু সেবার সাথে কোন ধরনের আপোষ করবে না।
২। ভাড়া নির্ধারণের সাথে সাথে প্রথম স্টপেজ থেকে শেষ স্টপেজ পর্যন্ত প্রতিটি স্টপেজে পৌঁছানোর সময় নির্ধারণ করা। এক্ষেত্রে, বাসের আইনসিদ্ধ গতি এবং দূরত্বই হবে সময় নির্ণায়ক মানদণ্ড। গুগল ম্যাপ অনুযায়ী ধনবাড়ী থেকে টাঙ্গাইল মহাসড়ক ধরে মহাখালী পর্যন্ত যেতে আনুমানিক সময় লাগার কথা ৪ ঘণ্টা ১৪ মিনিট (ট্র্যাফিক ছাড়া ৩ ঘণ্টা ৩২ মিনিট)। তবে, যানজটের কারণে যদি সময় ৬ ঘণ্টার বেশি লাগে, তবে যাত্রীদের জন্য হালকা নাস্তার ব্যবস্থা করা। কেননা, মানুষের খাবার হজমের গড় সময় ৬ ঘণ্টা বলে অনেক বাসেই এখন এ সেবা খুবই স্বাভাবিক, রোজা-রমজান হলে তো কথাই নেই।
৩। একজন মানুষের পানি পরিপাক করে রেচনক্রিয়া সম্পন্ন হতে গড়ে ২ ঘণ্টা লাগে। তাই, বাসে দীর্ঘ সময়ের চলাচলে অন্তত ২বার সবার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত ওয়াশরুম ব্যবহারের জন্য ৫ মিনিট করে যাত্রাবিরতি দিতে হবে। বিশেষ করে, নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এটি একটি অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যনীতি। এটি না করলে কিডনিতে পাথর, প্রস্রাবে প্রদাহ বা ক্যান্সারের মত যেসব দুরারোগ্য রোগ হতে পারে, তার দায়ভার পরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের বহন করা উচিৎ।
৪। বিশেষত রাতের বাসের দূরবর্তী স্থান থেকে আগত নারী যাত্রীদের জন্য আধুনিক সুযোগসুবিধাসম্পন্ন যাত্রী ছাউনী নির্মাণ করতে হবে। যাত্রী ছাউনীতে যাত্রীর জান-মালের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫। নামে নয় ‘বিনিময়’কে কার্যত সিটিং সার্ভিসে রূপান্তরিত করতে হবে। বাড়ী বাড়ী গিয়ে দাওয়াত দেওয়ার মত যাত্রী জোগাড়ের যে বদনাম রয়েছে, তা অবশ্যই ঘুচাতে হবে। এতে সবচেয়ে দামী সম্পদ সময়ের প্রচণ্ড অপচয় হয়। এছাড়াও কোন অবস্থাতেই (পিক কিংবা অফ-পিক সিজনে) দাঁড়ানো যাত্রী নেওয়া যাবে না।
৬। অভিজ্ঞতার পাশাপাশি চালক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মাদকাসক্তিহীনতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এছাড়াও হেল্পার ও সুপারভাইজরদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করতে হবে। দরকার হলে তাদেরকে নিয়োগের পর পূর্ণ পেশাদারিত্ব অর্জনের জন্য স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণের সুবিধা প্রদান করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা ও শ্লীলতাহানীর মত ন্যাক্কারজনক কোন ঘটনা ঘটলে জনসমক্ষে স্টাফদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
আধুনিক যুগ হচ্ছে বাজারজাতকরণের যুগ। তাই, সর্বোত্তম পণ্যেরও প্রচার না করলে তা ক্রেতা হারায়। অপরদিকে, সিটিজেন জার্নালিজমের সহজলভ্যতায় যেকোন ঘটনা ঘটার সময়ই তার খবর অন্যদের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। তাই, ‘বিনিময়’-এর জনপ্রিয়তা বাড়াতে এর যাত্রীসেবা বাড়ানো ছাড়া কোন উপায় নেই। কারণ, মনে রাখতে হবে, এক সময়ের বিকল্পহীন ‘বিনিময় প্রথা’ও কিন্তু কালের বিবর্তনে বাতিল হয়ে গেছে।

(অভয়ারণ্য প্রকাশনার স্বাধিকার সংখ্যা 'অসহযোগ'-এ প্রকাশিত)