স্থান-কাল-পাত্র, জাতি-ধর্ম-বর্ণ, দল-মত-লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষের জীবনের সবচেয়ে সোনালী সময় হল যৌবনকাল। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে যে, যৌবনের প্রচণ্ড গতিবেগ ও অদম্য শারীরিক-মানসিক শক্তির রীতিমত অপচয় হচ্ছে। কেননা, যে বয়সে প্রতিটি যুবক-যুবতীর নিজের সৃজনশীল কাজের দ্বারা নিজের এলাকা কিংবা দেশকে সহজেই সারা বিশ্বের কাছে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব, সে সময় একজন তরুণ হয়তো অকালে শেষ হয়ে যাচ্ছে আসক্তির ফলে। অপরদিকে, একজন তরুণীকে বাল্যবিয়ে বা নারী নির্যাতনের শিকার হয়ে গুটিয়ে বাঁচতে হচ্ছে বাকীটা জীবন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই যে অসীম সম্ভাবনার অপব্যবহার হচ্ছে তা ইচ্ছাকৃত, অনেক ক্ষেত্রে তা অনিচ্ছাকৃত। তবে অদূরদর্শী সম্মতি বা অনিচ্ছাকৃত অবদমনে অজ্ঞাতসারে ক্ষতিটা কিন্তু হচ্ছে শেষমেষ পরিবার, সমাজ, দেশ কিংবা রাষ্ট্রের; যার ক্ষতিপূরণ দেওয়া এক কথায় অসম্ভব। তাই, এই মুহূর্তে এ তিন মহামারী রোগ থেকে সমাজকে সুস্থ করতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে বিশেষ করে তরুণদেরকে।
মাদকঃ মানুষ নেশার জন্য যা ব্যবহার করে তাই মাদক দ্রব্য। সেটি হতে পারে ইনজেকশন, ধূমপান বা যে কোন মাধ্যম। তাই বলা যায় যে, হিরোইন, কোকেন, ইয়াবা, আফিম, মারিজুয়ানা, গাঁজা, ফেনসিডিল, বিয়ার, কেটামিন, স্পিড, বিভিন্ন রকমের ঘুমের ওষুধ থেকে শুরু করে জুতা লাগানোর আঠা পর্যন্ত সবই মাদকদ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত। জাতিসংঘ মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (UNDCP) মাদকের যে সংজ্ঞা দিয়েছে তা হল Intoxication (N): It is the state that results from the intake of a quantity of a substance which exceeds the individual’s tolerance and produces behavioral and physical abnormalities. মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ (সংশোধিত ২০০৪) অনুযায়ী “মাদকদ্রব্য” অর্থ প্রথম তফসিলে উল্লিখিত কোন দ্রব্য এবং এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার কর্তৃক, সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, মাদকদ্রব্য বলিয়া ঘোষিত অন্য কোন দ্রব্য। এক্ষেত্রে ৩টি শ্রেণিতে মাদকদ্রব্যগুলোকে ভাগ করা হয়। ক-শ্রেণির মাদকদ্রব্য (হেরোইন, কোকেন এবং কোকা উদ্ভূত মাদকদ্রব্য, পেথিডিন, মরফিন ও টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল, অপিয়াম, ক্যানাবিস রেসিন বা অপিয়াম উদ্ভূত, মেথাডন ইত্যাদি), খ-শ্রেণির মাদকদ্রব্য (গাঁজা বা যে কোন ভেষজ ক্যানাবিস, ফেনসাইক্লিআইন, মেথাকোয়ালন এলএসডি, বারবিরেটস এ্যামফিটামিন, অথবা এইগুলির যে কোনটি দ্বারা প্রস্তুত মাদকদ্রব্য ইত্যাদি) এবং গ-শ্রেণির মাদকদ্রব্য। এছাড়া “মাদকাসক্ত” অর্থ শারীরিক বা মানসিকভাবে মাদকদ্রব্যের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তি বা অভ্যাসবশে মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারী। আবার, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১২) অনুসারে “তামাক” অর্থ কোন নিকোটিনা টাবাকাম বা নিকোটিনা রাসটিকার শ্রেণিভুক্ত উদ্ভিদ বা এতদ্সম্পর্কিত অন্য কোন উদ্ভিদ বা উহাদের কোন পাতা বা ফসল, শিকড়, ডাল বা উহার কোন অংশ বা অংশ বিশেষ। “তামাকজাত দ্রব্য” অর্থ তামাক, তামাক পাতা বা উহার নির্যাস হইতে প্রস্তুত যে কোন দ্রব্য, যাহা চোষণ বা চিবানোর মাধ্যমে গ্রহণ করা যায় বা ধূমপানের মাধ্যমে শ্বাসের সহিত টানিয়া লওয়া যায় এবং বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, গুল, জর্দা, খৈনী, সাদাপাতা, সিগার এবং হুক্কা বা পাইপের ব্যবহার্য মিশ্রণও (mixture) ইহার অন্তর্ভুক্ত। আর “ধূমপান” অর্থ কোন তামাকজাত দ্রব্যের ধোঁয়া শ্বাসের সহিত টানিয়া নেওয়া বা বাহির করা, এবং কোন প্রজ্বলিত তামাকজাত দ্রব্য ধারণ করা বা নিয়ন্ত্রণ করাও ইহার অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে দেশের মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়)। আরও ভীতিজনক তথ্য হলো, প্রতি ১৭জনে একজন তরুণ মাদকাসক্ত। UNDCP’র তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর বিক্রি হওয়া ইয়াবার মাত্র ১০% ধরা পড়ে। ২০১৬ সালে দেশে ২ কোটি ৯৪ লাখ ইয়াবা ধরা পড়ে যা মোট বিক্রির (৪০ কোটি) কিয়দংশ। আমাদের রাষ্ট্রীয় বাইবেল সংবিধানের ১৮তম অনুচ্ছেদ (জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা)-এ আমরা দেখতে পাই, (১) জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষতঃ আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷ (২) গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷ এছাড়াও অতি সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সাথে খেলোয়াড়দের মত ডোপ টেস্ট সংযুক্ত করার পরিকল্পনাটি নিঃসন্দেহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
বাল্যবিয়েঃ শিশু আইন, শিশুনীতিসহ বিভিন্ন আইন ও নীতি এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদসহ বিভিন্ন সনদ অনুসমর্থন করে সরকার ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তাই বলা যায়, ১৮ বছরের নিচের কোন নাবালিকাকে বিয়ে দেওয়াই (কারণ, তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়স হয় না) বাল্যবিয়ে। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০-এ বলা আছে “শিশু” অর্থ অনধিক ষোল বৎসর বয়সের কোন বালিকা। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৪ নামে আইনের খসড়ায় উল্লেখ আছে, ‘যুক্তিসংগত কারণে মা-বাবা বা আদালতের সম্মতিতে ষোলো বছর বয়সে কোনো নারী বিয়ে করলে সেই ক্ষেত্রে তিনি “অপরিণত বয়স্ক” বলে গণ্য হবেন না।’ এছাড়াও বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬ নামে আইনের খসড়ার ১৯ ধারায় আছে, এ আইনের অন্যান্য বিধানে যা কিছুই থাকুক না কেন বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশে এবং পিতা-মাতার সম্মতিতে বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বিয়ে হলে তা এই আইনে অপরাধ বলে গণ্য হবে না’। সুতরাং, আইন-আদালতের হিসেবে যাই থাকুক না কেন, ৬৪% বাল্যবিয়ে দেওয়া মেয়ের (প্রথম আলো, ৯-০২-’১৮) অকালে গর্ভধারণজনিত সংকট চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুযায়ী কিন্তু কোনক্রমেই কমে না।
নারী নির্যাতনঃ ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘ প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদনে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা/ নির্যাতন সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘নারী নির্যাতন এমন একটি নিন্দনীয় অপরাধমূলক কাজ যার ফলে নারী দৈহিক, মানসিক ও যৌন হয়রানির শিকার হয় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।’ নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গে জাতিসংঘের সংগঠন প্রণীত নারী নির্যাতনের বিভিন্ন রূপের তালিকা নিম্নরূপঃ
পরিবার
দৈহিক আগ্রাসনঃ হত্যা যৌতুক ও অন্যান্য, দৈহিক আঘাত ও প্রহার, যৌন অঙ্গহানি, ভ্রূণ হত্যা, শিশু হত্যা, খাদ্য বঞ্চনা, চিকিৎসা সেবায় বঞ্চনা, প্রজনন ঘাটতি বলপ্রয়োগ/ নিয়ন্ত্রণ, যৌন অত্যাচার, ধর্ষণ, মানসিক অত্যাচার, আটকে রাখা, বলপূর্বক বিবাহ দান, প্রতিশোধের ভীতি প্রদর্শন
সম্প্রদায়
(সামাজিকগোষ্ঠী, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি)-এর ভিতরে বা বাইরে নারীর উপর নির্যাতনঃ দৈহিক অত্যাচার, দৈহিক আঘাত ও প্রহার, দৈহিক শাস্তি প্রদান, প্রজনন ঘাটতি বলপ্রয়োগ/ নিয়ন্ত্রণ, ডাইনী দাহ, সতীদাহ, যৌন হামলা, ধর্ষণ
কর্মস্থলে নির্যাতনঃ যৌন আগ্রাসন, হয়রানি, ত্রাস/ ভীতি প্রদর্শন, নারী পাচার, জবরদস্তি পতিতাবৃত্তি
তথ্য মাধ্যমঃ অশ্লীল সাহিত্য, নারীদেহকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করণ।
গোষ্ঠী
রাজনৈতিক নির্যাতন (নীতি, আইন ইত্যাদি): বেআইনী আউট, জবরদস্তি সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা বিনষ্টকরণ, জবরদস্তি গর্ভধারণ, অরাষ্ট্রীয় এজেন্টদের নির্যাতন বরদাস্ত করণ।
হেফাজতে নির্যাতন (সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ইত্যাদি): ধর্ষণ, নিপীড়ন
নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডও সনদ তিনটি মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এগুলো হলঃ সমতা নীতি, বৈষম্যহীনতার নীতি এবং শরিক রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বের নীতি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯, ২৭, ২৮ (১), (২), (৩), (৪) ও ২৯ (১), (২) অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষের সম অধিকারের কথা বলা আছে। এছাড়াও ১০, ২৬নং অনুচ্ছেদে উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ফলে, প্রশাসনে ১ম শ্রেণিতে ১০ এবং ২য় শ্রেণিতে ১৫ শতাংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। জাতীয় মহিলা সংস্থার মতে, নির্যাতন দৈহিক হতে পারে বা মানসিক হতে পারে। কাউকে দৈহিক কষ্ট দেওয়া, কাউকে প্রহার করা কিংবা কাউকে মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া, কাউকে পদে পদে খোঁটা দেওয়া সবই নির্যাতন। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের যেসব রূপ হামেশাই দেখা যায় সেগুলো হলঃ ১. শারীরিক নির্যাতন, ২. ধর্ষণ বা বলৎকার, ৩. যৌন হয়রানি, ৪. এসিড নিক্ষেপ, ৫. তালাক, ৬. যৌতুকের বলী, ৭. মানসিক নির্যাতন, ৮. আর্থিকভাবে নির্যাতন, ৯. নারী পাচার, ১০. গণিকা বৃত্তি, ১১. অশ্লীল সাহিত্য, ১২. বিজ্ঞাপনে ও সুন্দরী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নারীকে পণ্যে পরিণতকরণ, ১৩. পরিবারে নারী নিগ্রহ, ১৪. অপহরণ, ১৫. উত্যক্ত করা বা মৌখিক নির্যাতন ইত্যাদি। নারীরা স্বামী বা সঙ্গী কিংবা সঙ্গী নন এমন পুরুষের দ্বারা শারীরিক ও যৌন উভয়প্রকার নির্যাতনের শিকার হন। এছাড়াও সঙ্গী দ্বারা মানসিক, অর্থনৈতিক এবং স্বামীর সাথে বয়স পার্থক্যের কারণজনিত নির্যাতনের শিকার হন। অপরদিকে সঙ্গী নন এরকম পুরুষ দ্বারা নির্যাতনের দৃষ্টিভঙ্গি, শৈশবে নির্যাতন, নারী সদস্য হিসেবে পরিবারে যৌন হয়রানি/ উত্যক্তকরণের অভিজ্ঞতার শিকার হন অনেক নারী। নারী নির্যাতন নিয়ে সরকারের প্রথম জরিপে দেখা যায় যে, ২০ থেকে ৩৪ বছর বয়সী নারীরা যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছেন। শহরের তুলনায় গ্রামে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে। এছাড়াও বাইরের মতো ঘরের ভেতরেও স্বামী ও অন্যান্য আপনজনের কাছেই নারী ঝুঁকির মধ্যে থাকেন এবং নির্যাতনের সম্মুখীন হন। বিয়ের আগেও প্রায় ৪২ শতাংশ ১৪ বছর বয়সের আগেই জোরপূর্বক যৌনসম্পর্ক করতে বাধ্য হন, আর ৩৫ শতাংশ নারীর প্রথম এ অভিজ্ঞতা হয় ১৯ বছর বয়সে পা দেওয়ার আগেই। অর্থনৈতিক নির্যাতনও গ্রামে একটু বেশি দেখা যায়। এমনকি ভোট দেওয়ার মত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তেও তারা বাধ্য হন অন্যের মতামতে কাজ করতে।
নারী নির্যাতনের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত যে রূপগুলো বর্তমানে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে তাদের বর্ণনা নিম্নরূপঃ
ধর্ষণঃ নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে (২০০০) বলা আছে, নিজের স্ত্রী বাদে ১৬ বছরের বেশি বয়সী মেয়ের সম্মতি ছাড়া অথবা তাকে ভয় দেখিয়ে বা প্রতারণামূলকভাবে রাজি করিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গম মানেই ধর্ষণ। তবে নিজ স্ত্রীর বিষয়টি ভিন্ন। তার বয়স ১৩-এর কম না হলে দণ্ডবিধিতে ধর্ষণ বিবেচনায় আনার সুযোগ নেই। ১৬ বছরের কম বয়সী কোন মেয়ের সাথে সম্মতিতে বা অসম্মতিতে যৌন মিলনকেও ধর্ষণ বলা হয়। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না যে, অনেক পুরুষও ধর্ষণের শিকার হন। যেমনঃ যৌনানন্দ লাভ বা বিকৃত যৌনাচারের কারণে বয়েসী কোনো নারী দ্বারা নাবালক বা বয়েসে ছোট কারো ধর্ষিত হওয়া কিংবা জেল, মক্তব বা অন্যত্র অন্য পুরুষ দ্বারা ধর্ষিত হওয়া। তবে যেহেতু অধিকাংশ ধর্ষণ পুরুষরাই করে তাই ধর্ষণ বলতে নারী ধর্ষণকেই নির্দেশ করা হয়। ডা. এমএ হাসান পরিচালিত ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির তথ্য অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধকালীন ১ লাখ ৬২ হাজার নারী ধর্ষণসহ নির্যাতনের শিকার এবং আরও ১ লাখ ৩১ হাজার হিন্দু নারী স্রেফ গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন। উন্নত দেশে ডেট রেপ বা অভিসার ধর্ষণ হলো ধর্ষণের প্রধান কারণ। তবে ভয়ের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশেও ডেট রেপ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে।
যৌতুক প্রথাঃ নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ অনুযায়ী “যৌতুক” বলতে বোঝায় কোন বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সহিত জড়িত বর পক্ষের অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে, বিবাহের পণ হিসাবে বিবাহের কনে পক্ষের নিকট দাবীকৃত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ; অথবা কোন বিবাহের কনে পক্ষ কর্তৃক বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সহিত জড়িত কনে পক্ষের অন্য কোন ব্যক্তি কতৃক উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে, বিবাহের পণ হিসাবে বিবাহের বর পক্ষের নিকট দাবীকৃত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ। ২০১৭ সালে সংঘটিত নির্যাতনের ৩২% যৌতুকজনিত কারণে ঘটেছে (সমকাল, ৬-০৩-’১৮)।
পাচারঃ জাতিসংঘের মতে ‘শোষণের উদ্দেশ্যে হুমকি বা শক্তি প্রয়োগ অথবা অন্যান্য ধরনের বাধ্যকরণ, অপহরণ, প্রতারণা, বিশ্বাসহরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার অথবা হুমকিপূর্ণ স্থান অথবা একজন ব্যক্তির উপর অপর ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ আরোপের উদ্দেশ্যে অর্থের লেনদেন বা সুবিধা আদায়করণ’।
মৌখিক নির্যাতনঃ যৌন নিগ্রহমূলক তীব্র বাক্যবাণের দ্বারা এ অপরাধ সংঘটিত হয়।
তারুণ্যঃ তরুণ বলতে একতরফাভাবে শুধু বয়সে কচি ছেলেকেই বুঝায় না। এটি একটি সর্বজনীন অভিধা যা নারী, পুরুষ এমনকি বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য হতে পারে। তারুণ্য হলো মানসিক ও শারীরিক উভয় অবস্থার সর্বোচ্চ উন্নতির সমন্বিত শিখরবিন্দু। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় তার বাহ্যিক বা শারীরিক তারুণ্যের কমতি নেই কিন্তু তার অভ্যন্তরীন জগৎ তারুণ্যের ছিঁটেফোঁটাহীন। আবার অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তার মনে চিরবসন্তের তারুণ্য কিন্তু শরীরের জ্যামিতিক বলিরেখা বলছে তার বয়স বেড়েছে। মানুষের মনোজাগতিক শক্তিই মানুষকে অমিত তেজশক্তিতে বলীয়ান করে।
বর্তমান অবস্থাঃ গণমাধ্যমে মাদক, বাল্যবিয়ে কিংবা নারী নির্যাতনের যে চিত্র প্রকাশিত হয় তা নিশ্চিতভাবেই এ ধরনের ঘটনার ভগ্নাংশমাত্র। আবার, সব দেশেই এ বিষয়গুলো কম উত্থাপিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের হলিউডের অভিনেত্রীদের সাথে ঘটে যাওয়া যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদস্বরূপ ফেসবুকে মি টু হ্যাশট্যাগের ছড়াছড়ির কথা।
বাংলাদেশ একটি যৌন রক্ষণশীল দেশ। এছাড়াও এ দেশে যৌন শিক্ষা বা যৌনতা সম্পর্কিত গণধারণা অবৈজ্ঞানিক ও কল্পনাপ্রসূত। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ এখনও জানে না যে, স্ত্রীর সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনসম্পর্ক স্থাপন এবং অন্যান্য যৌন অপরাধ সংঘটনকে একত্রে বৈবাহিক যৌন নিগ্রহ বলা হয়। আমাদের দেশে বৈবাহিক জীবনে এক বা একাধিকবার বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯০ শতাংশের বেশি নারী। কিন্তু এরচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক কথা হলো যে, বৈবাহিক ধর্ষণ সম্পর্কে অধিকাংশ নারীর ধারণাই নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে দেখা গেছে, এ দেশের ৮০ শতাংশ নারী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার। এছাড়াও তাদের তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সালে বাংলাদেশে নির্যাতিত নারীর ৮৭ ভাগ স্বামী/ সঙ্গী দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলো। অনেকে বলেন অশালীন পোশাক পরা বা তথাকথিত শারীরিকভাবে সুন্দরী মেয়েরা বেশি ধর্ষণের শিকার হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায় যে, এ ধারণাগুলো সত্য নয়। এমনকি ধর্ষণের ক্ষেত্রে ৬৬% নারী দরিদ্র হলেও বৈবাহিক অবস্থা তেমন ধর্তব্যের বিষয় না। কেননা, বাস্তব জীবনে আমরা দেখি, ধর্ষিতা পূর্ণবয়স্ক নারীর সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি নারীশিশু (সমকাল) এবং অনেক ছোট-ছোট ছেলেরাও ধর্ষণের শিকার হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী গত সাড়ে পাঁচ বছরে দেশে ৫,২৪৮জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা জানিয়েছে গত ৬ মাসে ১৪১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শিশু অধিকার ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৬ মাসে ২৯৮ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কিশোরীদের রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে, প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের হেনস্তা করা হচ্ছে, মুঠোফোনে আপত্তিকর ছবি তুলে তা প্রচার করা হচ্ছে। বছর দু-এক আগে আইসিডিডিআর,বি পুরুষদের ওপর একটি জরিপ চালায়। তাতে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, আপনি কি নারীকে অধস্তন মনে করেন? ৯৭ শতাংশ পুরুষের উত্তর ছিল হ্যাঁ। নারীদের মাধ্যমে যদি বাংলাদেশকে বিশ্বে পরিচয় দিতে হয় তবে বলতে হবে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মাতৃ মৃত্যুহারের দেশ। এখানে বয়স্ক নারী সাক্ষরতার হার পুরুষের তুলনায় কম, নারীর গড় আয়ু পুরুষের তুলনায় কম, নারী নির্যাতন সহনীয় মাত্রার উর্ধ্বে। সিডও সনদের দুইটি ধারার ২ নং এবং ১৬-১(গ) সরকারের সংরক্ষণ এখনও বলবৎ। ২ নং ধারাটিকে বলা হয় সনদের প্রাণ। এ ধারায় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক রীতিনীতি, প্রথা, আচার-ব্যবহার, নিষিদ্ধ করা হয়েছে ও বৈষম্য বিলোপ করে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতার নীতিমালা গ্রহণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং ধারা ১৬-১(গ)তে আছে বৈবাহিক সর্ম্পক বিদ্যমান অবস্থা ও বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের একই অধিকার থাকবে। পবিত্র কুরআন সুন্নাহ ও শরীয়ত আইনের বিরোধী বলে আপত্তি জানিয়ে বাংলাদেশ সরকার এই দুইটি ধারা সংরক্ষণ প্রত্যাহারের স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছে না। অপরদিকে, যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০ মোতাবেক যৌতুক গ্রহণই নয়, যৌতুক প্রদান ও যৌতুক দাবি করাও শাস্তিমূলক অপরাধ। এ আইন অনুযায়ী যৌতুক দাবি করা কিংবা আদান-প্রদানের এক বছরের মধ্যে ফৌজদারী আদালতে মামলা করতে হবে। এজন্য দায়ী ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ৫ বছর সর্বনিম্ন একবছর কারাদণ্ড বা জরিমানা কিংবা উভয় শাস্তি প্রদান করা যাবে। এ আইনের অনেক ধারা-উপধারা রয়েছে যা আমরা অনেকেই জানি না। অথচ এটি জানা অত্যন্ত প্রয়োজন।
পুরো বাংলাদেশের এ ভয়াবহ চিত্রের একটি খণ্ডচিত্র আমাদের ধনবাড়ী উপজেলা, বিশেষত পৌরসভা। ইদানীং এলাকায় ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের অবাধ প্রাপ্যতা আমাদেরকে স্তম্ভিত করে। এছাড়াও চুপি-চুপি বাল্যবিয়ে এবং নারী নির্যাতন প্রকাশ না হলেও আশে-পাশের অনেকেই এর ভুক্তভোগী। এর কারণ পর্যালোচনা করলে বলা যায় যে, সামাজিক অবক্ষয় এর মূল কারণ। সামাজিক অবক্ষয় থেকে জন্ম নিচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। জনবিচ্ছিন্নতা বা ভার্চুয়াল জগতে মাত্রাতিরিক্ত সময় অপচয় যুবসমাজের মধ্যে তৈরি করছে হতাশা। যার ফলে কর্মহীনতা ও অন্যান্য হতাশা কাটানোর আপাত সমাধান হিসেবে বাড়ছে মাদকাসক্তি। অনেক ক্ষেত্রে মাদকাসক্তরাই হয়ে উঠছে বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতনের (২%) মূল কারণ।
উত্তরণের পথে তরুণদের সংযুক্ততাঃ আশার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ এখন কর্মক্ষম তরুণ। এই অসম্ভবকে সম্ভব করা তারুণ্যকে মাদক, বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতনের অসমসাহসিক যোদ্ধা হিসেবে ব্যবহার করা এখন সময়ের দাবী। তারুণ্যের রয়েছে অবাধ অপ্রতিরোধ্য সর্বভুক গতি। যে গতির কারণে উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু সর্বত্র সে সমভাবে পূজনীয়। কিন্তু এই গতিই তার দুর্বলতা, যা তাকে ধ্বংস করতে যথেষ্ট। গতিকে যদি সঠিক পথে পরিচালিত করা যায়, তবে তা চলার পথে সোনা ফলায়, কিন্তু গতি কুপথে গেলে তা অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষতি সাধন করে। বর্তমান প্রজন্মের তারুণ্য বিভ্রান্তি, বিশ্বাস ব্যবসায়, প্রলোভন, অনৈতিকতা, মেকি সুখের মায়া, অহংবোধ, হুজুগ, মাদক, যৌন বিকৃতি, সম্পর্কের ফাটল, অতিযান্ত্রিকতা, সকাল-সন্ধ্যা প্রেম, হতাশা, আত্মহত্যা প্রভৃতি নানা রকম ধোঁয়াশায় আবৃত। তাদের পৃথিবীকে পরিবর্তন করার মত শক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে ডাঙায় তোলা মাছের মত খাবি খাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একটাই পথ। তা হল যুগপৎভাবে স্বশিক্ষা ও সুশিক্ষা। একমাত্র মানবিক, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী শিক্ষাই পারে প্রবল তারুণ্যের বারুদশালায় দেয়াশলাই কাঠির মত কাজ করতে। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহায়ক হিসেবে প্রয়োজন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া কিংবা বৌদ্ধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। কেননা, সংগঠিত শক্তি যেকোন বৃহৎ অপরাধকে সহজেই পরাজিত করতে পারে। তরুণদের মনে রাখতে হবে, বর্তমানে আমরা কোনো রূপকথার রাজ্যে বসবাস করি না যে, রাজপুত্র এসে তার কারিশমা দিয়ে পরিস্থিতি অনুকূল করবেন। বরং একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে আমরাই আজ একেকজন রাজপুত্র, সুপারম্যান, ব্যাটম্যান বা স্পাইডারম্যানের মত সুপার হিরো। পুরো পৃথিবীটাই আজ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এক্ষেত্রে অনেক দুরাশার মাঝে একটি আশার আলো আমিসহ প্রায় সব অধূমপায়ী সদস্যদের সংগঠন অভয়ারণ্য (Sanctuary)। মাদক নিরাময়ে এ সংগঠনের বেশ কিছু অপ্রকাশিত ব্যক্তিপর্যায়ের কাউন্সেলিং ও গাইডেন্স পরিচালিত হয়ে আসছে। আবার, গত ৪ সেপ্টেম্বর (২০১৭) রাতে সংগঠনটির এক সদস্যের তৎপরতায় পূর্ববর্তী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব শামীম আরা রিনির হস্তক্ষেপে বন্ধ হয় একটি বাল্যবিয়ে। এছাড়াও গত ২৪ এপ্রিল (২০১৮) বিকেলে সংগঠনের সদস্যদের মাধ্যমে বন্ধ হয় একটি পাচার ও শিশুধর্ষণ।
সুপারিশ/ প্রস্তাবনাঃ
প্রতিরোধমূলকঃ
১। অবকাঠামো উন্নয়নের মত এক্ষেত্রেও পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ভিত্তিতে একটি নাগরিক সেল গঠন করতে হবে। সংগঠন ও প্রশাসনের সম্মিলিত উদ্যোগে এটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন সেলের মত কাজ করবে।
২। সাংস্কৃতিক, সামাজিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধূলায় তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি স্থাপন ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যাবলি বৃদ্ধি করতে হবে।
৩। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধে নিজস্ব সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে কেন্দ্রীয়ভাবে কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
৪। মূল্যবোধের জাগরণের জন্য যৌনশিক্ষা প্রবর্তন ও নৈতিক শিক্ষা জোরদার করতে হবে। লিঙ্গ বা অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সব মানুষ সমান, এ চিন্তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। যেকোন অপরাধীর ‘ভিলেন ইমেজ’ তৈরি করতে হবে। অপরাধী যতই আপনজন হোক না কেন, তাকে ‘সোশ্যাল আউটকাস্ট’-এর দৃষ্টিতে দেখার গণদৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে।
৫। ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন ১৮৭২, বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ (সংশোধিত ’৮৪), মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১, বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) আইন ১৯৭৪, যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০ (সংশোধিত ’৮৬), পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ (সংশোধিত ২০০৪), নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০, আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০, এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১২), ভ্রাম্যমান আদালত আইন ২০০৯, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ ইত্যাদির যুগোপযোগী নবায়ন ও কার্যকর বাস্তবায়ন করতে হবে।
৬। বেকারত্ব নিরসনে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তরুণদেরকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত করতে হবে।
প্রতিকারমূলকঃ
১। ইতিবাচকভাবে আসক্তদেরকে পূর্বের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য সহযোগিতা করতে হবে।
২। অভিযুক্তদের রাজনৈতিক আশ্রয় বা অন্য কোন প্রকার প্রশ্রয় না দিয়ে অবশ্যই বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সালিশের মাধ্যমে নামমাত্র জরিমানায় মীমাংসা অথবা অভিযুক্তদের সাথে বিয়ে দেওয়ার মত হাস্যকর সমাধান বাদ দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক উন্মুক্ত বিচার করতে হবে। এতে ভবিষ্যতে অন্যরা অপরাধ করতে নিরুৎসাহিত হবে। বিচার বহির্ভূত হত্যা বন্ধ করতে হবে। কেননা, হত্যা কোন সমাধান নয়, বরং এটি মানবাধিকার হরণ।
৩। ভুক্তভোগীকে অপরাধবোধ কিংবা গ্লানি থেকে বের করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ অনুযায়ী সংবাদ মাধ্যমে নির্যাতিতা নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বাধা-নিষেধ মেনে চলতে হবে। অপরাধের শিকার হয়েছেন এরূপ নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তৎসম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোন সংবাদ পত্রে বা অন্য কোন সংবাদ মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করতে হবে যাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়।
৪। প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি আক্রান্ত নারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে সাধারণত তারা যে ৩টি কারণে ধর্ষণ রিপোর্ট করতে দ্বিধাবোধ করেনঃ ক. ব্যক্তিগত স্পর্শকাতরতা; খ. ধর্ষক বা তার পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে আরো হুমকি বা প্রাণ-নাশের আশংকা; গ. পুলিশ অথবা বিচার বিভাগের উদাসীনতা, যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেওয়া কিংবা নিজেরাই নাজেহাল হওয়ার আশঙ্কা (Wright, 1991)।। এক্ষেত্রে তাদের সুরক্ষার ব্যাপারটি পুলিশ প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে।
৫। অপরাধীর বিকৃত মানসিকতার ও ভুক্তভোগীর পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
শামীম আল মাহমুদ (শিমুল)
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, অভয়ারণ্য (Sanctuary)
(গত ১২ জুন ধনবাড়ী উপজেলা অডিটোরিয়ামে 'মাদক, বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতন রোধে তারুণ্য' শীর্ষক সেমিনারের মূলপ্রবন্ধ হিসেবে পঠিত)