মঙ্গলবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৪

 আওয়ামী লীগ বলে আমি জামায়াত করি, জামায়াত বলে আওয়ামী লীগ। বিএনপি বলে বাম করি, বাম বলে বিএনপি! 

আমি আসলে কী করি? 

যেখানেই অন্যায়, যেখানে অন্যায্য-অপরাধ, আমি তার বিরুদ্ধে কলম ধরি, বয়ান করি।

গণমানুষের একজন হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করাই আমার রাজনৈতিক পরিচয়।

#সত্যেরপাশে #প্রতিবাদেরকন্ঠ #ন্যায় #গণমানুষ #অন্যায়েরবিরুদ্ধে

মঙ্গলবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

শতবর্ষী খেলার মাঠে গরুর হাটের আধিপত্য রোধে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক এমপি মহোদয় সমীপে স্মারকলিপি


মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়,
দেশের নীতি নির্ধারণী কাজে আপনাকে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয় জেনেও আমরা আপনার কাছেই আমাদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করার জন্য বার বার ছুটে আসি। আপনিও আমাদের ডাকে বরাবরই সাড়া দেন। সে সাহস থেকেই এলাকার অভিভাবক ও আমাদেরই কাছের একজন হিসেবে আজ একটি যৌক্তিক দাবি নিয়ে হাজির হয়েছি আপনার সামনে। জানি, স্বভাবসুলভ সরল স্নেহে আপনি আমাদেরকে নিরাশ করবেন না।
সমাজতত্ত্ববিদরা মনে করেন, একটি জাতি সরকারের কাছ থেকে প্রথমে যা চায় তা হলো নিরাপত্তা। এরপর দাবি করে কল্যাণ। পরিশেষে চায় উন্নয়ন ও মুক্তি। ধনবাড়ীর প্রবাদপুরুষ নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী (২৯ ডিসেম্বর ১৮৬৩ - ১৭ এপ্রিল ১৯২৯) সফলভাবে এলাকার জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কল্যাণের জন্য ১৯১০ সালে ক্রিকেট খেলার মাঠ হিসেবে বহুল পরিচিত ‘বড় মাঠ’টিকে উন্মুক্ত করেন। শুধু তাই নয়, তাবৎ ময়মনসিংহ অঞ্চলের সব রাজা-জমিদার ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের ক্রিকেট খেলার সুবিধার্থে সুদূর ইংল্যান্ড থেকে ঘাসের বীজ এনে তৈরি করা হয় কার্পেট ঘাসের ক্রিকেট গ্রাউন্ড। কালের বিবর্তনে মাঠটির সংরক্ষণের দায়িত্ব বর্তায় ধনবাড়ী নওয়াব ইনস্টিটিউশনের ওপর। একই সাথে মাঠটি হয়ে ওঠে আগামী দিনের যাদুকর সামাদের স্বপ্নের কারখানা ও সাকিব-মাশরাফিদের ইডেন গার্ডেন।
স্বর্গের কর্তৃপক্ষের আদেশ অমান্য করে স্বর্গোদ্যান থেকে আদম-হাওয়া বিতাড়িত হলেও, ইদানীং কোনো অপরাধ ছাড়াই ভবিষ্যতের তারকা খেলোয়াড়রা মাঠ থেকে বিতাড়িত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছর যাবৎ খেলোয়াড়ী বুটের এ অভয়ারণ্যে অযাচিতভাবে অনুপ্রবেশ করছে চতুষ্পদ গরুর দ্বিখণ্ডিত খুরের ছাপ। জন্ম থেকেই খেলার মাঠ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেও আপনার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত স্কুলমাঠ ক্রমেই পরিণত হচ্ছে দুর্গন্ধযুক্ত গোবরসমৃদ্ধ গরুর হাটে।
খলিফা পট্টি রাস্তার শেষে মধুছন্দা হলের বাম কোণার তৎকালীন বটতলার পেছনের অংশের সেই বিরাট গরুর বাজার কেন যেন ক্রমেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোলে জায়গা করে নিচ্ছে। ধনবাড়ী সরকারি কলেজ মাঠ, ধনবাড়ি কলেজিয়েট মডেল স্কুল মাঠের পর আক্রান্ত হচ্ছে সরকারি এ বিদ্যাপীঠের পবিত্র মাঠ। খেলার মাঠ যদি তার জন্মপরিচয়ই হারায়, তাহলে কীভাবে শিক্ষার্থীরা সুর করে সমবেত আবৃত্তি করবে সুনির্মল বসুর ‘সবার আমি ছাত্র’ কবিতার পঙক্তি ‘খোলা মাঠের উপদেশে-/ দিল-খোলা হই তাই রে’? কিংবা, ‘একটি মাঠের আত্মকাহিনী’ রচনার উপসংহারে তারা কীভাবে এড়াবে কান্নাজড়িত দুঃখগাথা?
অর্থনৈতিক লাভকে আমলে এনে যে বা যারাই এ অপকর্মটি করছে তাদের দুরভিসন্ধি মাঠে মারা খেতে বাধ্য। কেননা, কলকাতার গড়ের মাঠের মত আমাদের মেলার মাঠ আমাদের সংস্কৃতি ও পরিচিতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন-এর মতে, ‘the fundamental source of conflict in this new world will not be primarily ideological or primarily economic. The great divisions among humankind and the dominating source of conflict will be cultural.’ বিশ্বাস না হলে ইতিহাস দেখুন, উঠতি বয়সের ছেলেদের খেলার মাঠে ব্রিটিশ সেনাছাউনি করার প্রভাবেই কিন্তু গতিশীল হয়েছিল মাস্টারদা’ সূর্য সেনের ভারত স্বাধীন করার প্রথম পদক্ষেপ।
তাই, আপনিই পারেন গরুর হাটের দৌরাত্ম্যে মৃতপ্রায় এ খেলার মাঠকে বাঁচাতে। আর মাঠ বাঁচলেই, বাঁচবে তারুণ্য।
নিবেদক
শামীম আল মাহমুদ (শিমুল)
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, অভয়ারণ্য (Sanctuary)
(ধনবাড়ীবাসীর পক্ষে)

শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৯

প্রচলিত নেতৃত্ব তত্ত্বঃ নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ প্রস্তাবনা


সূচনাঃ টেকসই উন্নয়ন ও শিল্পনির্ভর অর্থনীতির আজ এই যুগে নেতৃত্ব একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। যদিও সভ্যতার আদি লগ্ন থেকেই বলা যায় যে, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্যয়। জানা যায় যে, নেতৃত্ব নিয়ে প্রায় ১৩০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দেও কথাবার্তা চলেছিল। নেতৃত্ব শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Leadership. Leadership শব্দটি এসেছে Lead শব্দটি থেকে। Lead শব্দটি থেকে উদ্ভূত Leader Leading প্রত্যয় হতে ক্রমবিবর্তিত হয়ে Leadership-এর উদ্ভাবন হয়েছে। যার বাংলা প্রতিশব্দ হল নেতৃত্ব, অগ্রনায়কের কাজ, পরিচালনার কাজ, দলপতির নির্দেশনা কাজ ইত্যাদি।
Leadership বা নেতৃত্ব যেহেতু অনেক আগে থেকেই চর্চিত একটি সর্বজনীন বিষয়, তাই সময়ের সাথে সাথে এর প্রতি আচরণগত বা দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। প্রথম দিকে নেতৃত্ব বলতে প্রেষণা প্রদান করার ক্ষমতাকে সাধারণভাবে নির্দেশ করা হতোঅর্থাৎ, মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে কাজ করানোকেই নেতৃত্ব বলে নির্দেশ করা হতো। প্রথম দিকে মূলত সামাজিক নেতৃত্বকেই সাধারণভাবে নেতৃত্ব বলা হতো। আর নেতৃত্বের দরকারী বা প্রয়োজনীয় জায়গা ছিল যুদ্ধনীতি ও রাজ্য পরিচালনা নীতি। পরবর্তীতে সামাজিক সম্পত্তি নীতি বা সামন্ততন্ত্রের শেষ দিকে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পণ্য উৎপাদনের প্রতি জোর দেওয়া হয়। আধুনিক কালে অন্যদের আচরণ পরিবর্তন বা পরিবর্ধন কিংবা পরিমার্জনের ক্ষমতাকে নেতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মূল কথা হল, নেতৃত্ব হল কোন এক বা একাধিক লোকের নির্দেশনায় বহু সংখ্যক লোকের সম্মিলিত শ্রম দেওয়ার প্রক্রিয়া যাতে একটি নির্দিষ্ট কাজ সহজে সম্পন্ন হয়।
তাত্ত্বিকভাবে, নেতৃত্ব প্রত্যয়ে কালক্রমিক বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। তার ঢেউ ব্যবহারিক ক্ষেত্রেও কমবেশি বিদ্যমান। তবে, বর্তমানে আমাদের দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট থেকে শুরু করে স্বেচ্ছাসেবক নেতৃত্বেও তাত্ত্বিকতা থেকে বেশ বিচ্যূত ব্যবহারিক প্রয়োগ দেখা দেয়। তার একটি কারণ অবশ্য স্বল্প শিক্ষা তথা সুশিক্ষার স্বল্প প্রসারতা। প্রাচীন গ্রীসের মানুষজন প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে অভ্যস্ত ছিল তাতে কোন সমস্যা না হওয়ার কারণ হল তাদের বেশিরভাগ লোকই সুশিক্ষিত ছিল। বর্তমান সময়ে নেতৃত্ব নেতার সুবিধাকেন্দ্রিকতার গণ্ডিবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বেশিরভাগ সময় সুবিধা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে অনুসারীদের করায়ত্ত হয় না। নেতৃত্ব বর্তমানে একটি সুবিধা গ্রহণের হাতিয়ার হিসেবে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হচ্ছে। এমন অনেক নেতৃত্ব আছে যেখানে নেতা ও অনুসারীর মাঝে যোজন যোজন দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও নেতার বিপরীত আদর্শকে অনুসারী আঁকড়ে থাকে সুবিধা পাওয়ার আশায়। তবে, পিরামিড আকৃতির সুবিধাভোগীদের স্তরবিন্যাসের কারণে নেতা সুবিধাপ্রাপ্ত হলেও সুবিধাবঞ্চিতদের কাতারে থাকে শুধু অনুসারীরাই। আবার, Right man in right place কথাটি চর্চিত হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে অনেক সময় অর্থ কিংবা স্বজনপ্রীতির বশে তা ঘটে ঠিক উল্টো। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায় যে, নেতার নির্বাচিত হওয়ার আগের চিত্র আর অনুসারীদের সাথে তার সম্পর্কের চিত্র নির্বাচিত হওয়ার পর মেলানো দুষ্কর। তাই, বর্তমানে প্রচলিত নেতৃত্ব তত্ত্বের যেটুকু আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতার আয়ত্তের ভেতর পড়েছে তার আলোকে একে ত্রুটিহীন করতেই আমার এই প্রয়াস।
ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আমার নিজ জেলা টাংগাইলের বেশ কয়েকটি সংগঠনের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। তার ফলে, বিভিন্ন ধরনের নেতৃত্ব নীতি, তত্ত্ব ও রীতির প্রয়োগ দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বেশিরভাগ জায়গায়ই গণতান্ত্রিক নেতৃত্বকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছে। তবে, বিভিন্ন পরিস্থিতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে এর সাথে কোমল কঠিন বিভিন্ন উপাদানের সংমিশ্রণে একটি স্থানীয় কাঠামো দান করা হয়। তাই, আমি মূলত গণতান্ত্রিক নেতৃত্বগামী নেতৃত্ব তত্ত্বের প্রচলিত অসঙ্গতিকে তুলে ধরতে চাই ও তার নিরসনপূর্বক একটি নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ একটি নেতৃত্বের মডেল বা তত্ত্বের প্রস্তাবনা প্রদান করতে চাই।
এই আরোপিত কাজটি আমার একান্ত আগ্রহের জায়গা ও শিক্ষাপ্রক্রিয়ার সম্পন্ন করার একটি উপাদান হিসেবে করা। এটিতে আমি আমার নিজস্ব মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে আমি তাত্ত্বিকতা প্রণয়নের চেষ্টা করেছি। তাই, এটিতে আমার নিজস্ব বিশ্বাস, চিন্তা-চেতনা, ভালো লাগা ইত্যাদি প্রচ্ছন্নভাবে হলেও গুরুত্ব পাবে এটাই স্বাভাবিক। তবে, যথেষ্ট নিরপেক্ষতার জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি এটি প্রস্তুত করার চেষ্টা করেছি। তবু, এতে তাত্ত্বিক জ্ঞানের ব্যবহারের চেয়ে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকেই বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। তাই, সহায়ক গ্রন্থতালিকার আকার খুব বেশি লম্বা হয়নি। তবে, যেসব বই বা জ্ঞানভাণ্ডার থেকে তথ্য আহরিত হয়েছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করতে কোন ধরনের কার্পণ্য করা হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। তবে, নান্দনিক তাত্ত্বিকতার চেয়ে বাস্তবিক অভিজ্ঞতাকে ভিত্তি করে করা হয়েছে বলে যদি কেউ একে মন্ময় সাধারণীকরণ কল্পনা বলে আখ্যায়িত করতে চান, তবে আমি তাকে কিছুই বলবো না। তবে, এটুকু স্মরণ রাখা জরুরি যে, স্নাতকোত্তর শ্রেণির একজন ছাত্র ও সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার নিজের ইন্দ্রিয়গুলোর প্রতি পূর্ণ আস্থা বিরাজমান।
বর্তমান সময়ের বিশ্বায়নের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত দেশসমূহের মানুষের নিশ্চুপতার সংস্কৃতি ভাঙ্গতে হলেও প্রশ্ন করা দরকার। তাই, এটি হয়েতো কোন একটি প্রশ্নকে উসকে দেবে যা ভাঙ্গবে হাজার বছরের নৈশব্দ। তবে, এটি যদি সেরকম গুরুত্ববহ নাও হয়, তবু কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর মত বর্তমানের মানুষের মনে ভবিষ্যৎ চিন্তার সম্ভাবনা উঁকি দেওয়াতে পারলেও আমি খুশি। এই মডেলটি অনুসারীদের কথা মাথায় রেখে করা, তাই যদি কোন অনুসারীবাৎসল নেতা এর কিয়দংশও প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন তবে আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। এটি যেহেতু অনুসারীকেন্দ্রিক, তাই শিক্ষা প্রক্রিয়ার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মত যদি শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক তথা অনুসারী কেন্দ্রিক নেতৃত্বের যুগ আসে, তবে এটি সমাদর পেতে পারে। কিংবা বলা যায় না, এমনও হতে পারে যে, এই তত্ত্বটিই জোর করে অকালবোধিত করতে পারে অনুসারীকেন্দ্রিক নেতৃত্বের যুগের।
এই আরোপিত কাজটি করা হয়েছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংগঠনের নেতা ও অনুসারী হিসেবে কাজ করার সময় আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে। তাই, বলা যায় যে, অন্তর্দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণই এই কাজের প্রধান হাতিয়ার। তবে, পর্যবেক্ষণ করার সময় সচেতনভাবে এই কাজটি করার কথা মাথায় না থাকায় ঠিক ততোটা কাঠামোবদ্ধ বিন্যস্ত বিশ্লেষণ পাওয়া সম্ভব নয়। আবার, এ পর্যবেক্ষণ বাদে যাদেরকে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে, তারা যেহেতু সতর্ক বা জ্ঞাত ছিল না, তাই সঠিক ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এতে যে নেতৃত্বটি বেশি আলোকপাত করা হয়েছে তা হল স্বেচ্ছাসেবী নেতৃত্ব যাতে উৎসর্গ বেশি করে ফলাফল শূণ্য পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তাই, আদি, অকৃত্রিম ও যোগ্য নেতৃত্ব বিশ্লেষণ এতে রয়েছে।
উদ্দেশ্যঃ আরোপিত কাজটি করা হয়েছে শিক্ষাক্রমিক কাজের অংশ হিসেবে। এতে যেসব উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত করার চিন্তা করা হয়েছে সেগুলো হলঃ
1.      প্রচলিত নেতৃত্ব সংক্রান্ত আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভাগাভাগি
2.     নেতৃত্ব সংক্রান্ত নিজস্ব প্রস্তাবনার অবতারণা
3.     প্রচলিত নেতৃত্বের তত্ত্বের উপর নির্ভর করে একটি স্বতন্ত্র নেতৃত্ব তত্ত্ব উপস্থাপন
4.     প্রচলিত নেতৃত্ব তত্ত্ব সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা
বর্ণনাঃ নেতৃত্বের প্রায়োগিক গুরুত্বের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শিক্ষাবিদগণ তাঁদের গবেষণালব্ধ ফলাফল বিশ্লেষণ করে নেতৃত্বের কতিপয় তত্ত্বের অবতারণা করেছেন। এ পর্যন্ত নেতৃত্ব সম্পর্কে যেসব তত্ত্বের উদ্ভব হয়েছে তাদের সম্প্রসারিত অবস্থাকে সংক্ষিপ্ত কলেবরে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করলে নেতৃত্বের সমুদয় তত্ত্বগুলোকে নিম্নোক্ত উপায়ে শ্রেণিবিন্যাস করা যায়। যথাঃ
ক। আচরণভিত্তিক নেতৃত্বের তত্ত্ব (Behaviour Theory of Leadership)
খ। মিশ্র নেতৃত্বের তত্ত্ব (The Composite Theory of Leadership)
গ। পরিস্থিতি প্রেক্ষিত নেতৃত্বের তত্ত্ব (Situational Theory of Leadership)
ঘ। গুণাবলিভিত্তিক নেতৃত্বের তত্ত্ব (Trait Theory of Leadership)
ঙ। অনুগামী নেতৃত্বের তত্ত্ব (Follower Theory of Leadership)
ক। আচরণভিত্তিক নেতৃত্বের তত্ত্বঃ এ তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতে, নেতৃত্ব হচ্ছে মূলত নেতার বিশেষ আচরণগত সামষ্টিক প্রক্রিয়া। এ তত্ত্বে নেতার আচরণ কিংবা কাজের মাধ্যমেই নেতৃত্বের দায়িত্ব সম্পাদিত হয়ে থাকে। এ তত্ত্ব অনুসারে, আচরণের কারণেই সার্থক এবং ব্যর্থ নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটে থাকে। আচরণভিত্তিক নেতৃত্বের নেতার পুরস্কার কিংবা তিরস্কার সুনির্বাচিত থাকে। এ তত্ত্বের স্বপক্ষে কতগুলো গবেষণালব্ধ সমীক্ষণ রয়েছে। যেমনঃ
1.      মিচিগান সমীক্ষা মডেল
2.     ওয়াহাইও স্টেট সমীক্ষা মডেল
3.     ব্যবস্থাপকীয় গ্রীড মডেল
খ। মিশ্র নেতৃত্ব তত্ত্বঃ আধুনিক যুগে নেতৃত্বের তত্ত্বকে কতগুলো বিশেষ গুণাবলি অনুসারীদের প্রয়োজন চাহিদা ও সমস্যাবলি সাংগঠনিক পরিবেশ পরিস্থিতি এবং দল ভিত্তিক অবস্থা ইত্যাদি বিশেষ অবস্থার সাথে সাফল্যকরণ করা হয়েছে। বস্তুত, নেতৃত্বের অন্যান্য তত্ত্ব অপেক্ষা মিশ্র তত্ত্বটি একটু আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এর উপর আগেও অনেক গবেষণা হয়েছিল, এখনও চলছে। তবে, এখন পর্যন্ত এর কোন নির্ভরযোগ্য গবেষণালব্ধ ফলাফল বের হয়নি।
গ। পরিস্থিতি প্রেক্ষিত নেতৃত্ব তত্ত্বঃ পরিস্থিতিবাদীদের মতে, কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে নেতার আবির্ভাব ঘটে থাকে। কাজেই শুধুমাত্র গুণাবলির ভিত্তিতে নেতৃত্বের তৈরি হবে এসকল ক্ষেত্রে সুনিশ্চিত নয়। বরং পরিস্থিতিকে স্বীকার করে নেওয়াটাই এখানে শ্রেয়। এ তত্ত্বের মূল দর্শন হলো নেতা কাজ করবেন সে পরিস্থিতিতেই নেতৃত্বের ভিন্নতা এবং ধরনের আবির্ভাব ঘটে। নেতৃত্বের পরিস্থিতি তত্ত্বটি বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ তত্ত্ব অনুযায়ী কোন ব্যক্তি নেতৃত্ব সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরিহার্য গুণাবলির অধিকারী হয়ে বিশেষ কর্ম পরিবেশ বা পরিস্থিতিতে এ সকল গুণাবলির অনুশীলন বা চর্চা করে কতটুকু সফলতার পরিচয় দিতে পারেন তাকেই নেতৃত্বের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচিত হয়। যুগে যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সাপেক্ষে নতুন নেতৃত্বের আবির্ভাব হয়েছে। নেতৃত্বের পরিস্থিতি প্রেক্ষিত তত্ত্ব অনুযায়ী দুই ধরনের নেতৃত্বের মডেল পাওয়া যায়। যেমনঃ
১। ফ্রেড ফিডলার মডেল
২। হারসিও ব্ল্যাঞ্চার্ড মডেল
ঘ। গুণাবলিভিত্তিক নেতৃত্ব তত্ত্বঃ মানবীয় গুণাবলিভিত্তিক নেতৃত্বের তত্ত্বটি অতি প্রাচীন। একে আবার মহামানব তত্ত্ব বলা হয়। গ্রীস এবং রোমান সাম্রাজ্যে এ তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে। এ তত্ত্বের প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, নেতা জন্মগ্রহণ করেন, তাকে তৈরি করা যায় না। ঐশ্বরিক কৃপায় নেতা জন্মায়, প্রকৃতিগতভাবেই কতিপয় অতি মানবীয় গুণাবলি নিয়ে নেতা জন্মায় – Leader born naturally with special characters. তাকে মানুষ নিজ হাতে তৈরি করতে পারে না। অর্থাৎ, নেতার বৈশিষ্ট্য হলো জন্মগত এবং অর্জিত নয়। এ তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তাদ্বয় বার্নাড এবং অডোয়া টিউড-এর মতে, যেসকল গুণ বা মানবীয় বৈশিষ্ট্য একজন নেতাকে তার নেতৃত্বের আসনে আসীন করে তার অধিকাংশই আসে বংশ পরম্পরায় জন্মগত চেতনায়। পরিবেশ পরিস্থিতি কিছু কিছু গুণের অবারিত বিকাশ ঘটায় মাত্র। সম্প্রতি Stogdill কর্তৃক পরিচালিত জরিপ ফলাফল অনুযায়ী, নেতৃত্ব সংক্রান্ত এ মানবীয় গুণাবলিকে চারটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ
১। শারীরিক গুণাবলি
২। মানসিক গুণাবলি
৩। সামাজিক গুণাবলি
৪। কার্যাবলি সংক্রান্ত গুণাবলি
ঙ। অনুগামী নেতৃত্ব তত্ত্বঃ শিক্ষাবিদ স্ট্যান্ড ফোর্ড নেতৃত্বের এ অনুগামী তত্ত্বের উদ্ভাবন করেন। এ তত্ত্ব অনুযায়ী অনুগামী ব্যক্তিবর্গ বা অনুসারীবৃন্দ ঐ ব্যক্তিকেই নেতা বলে স্বীকৃতি দেয় যার মাধ্যমে সামাজিক, ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক অভাব অভিযোগ এবং চাহিদা পূরণের প্রত্যাশা পূর্ণ হয়। অতএব, অনুসারীদের প্রয়োজন ও চাহিদা পূরণের সন্তুষ্টির বিধান করার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিই হলেন এখানে নেতা। উক্ত নেতার নেতৃত্ব বা আচরণের মধ্য দিয়েই তাদের চাহিদাবলির পরিতৃপ্তি ঘটবে। অনুগামী নেতৃত্বের তত্ত্বে এ চেতনাই ফুটে ওঠে। এখানে নেতার গুণাবলি বংশগত হতে পারে। আবার অর্জিত এবং পরিস্থিতি সাপেক্ষে হতে পারে। অনুগামী তত্ত্ব অনুযায়ী অনুসারীদের আশা আকাঙ্ক্ষার পরিপূরণের তাৎপর্যময় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই নেতার নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা হয়। জনকল্যাণই এখানে মুখ্য বিষয়।
নেতৃত্বের ধরনঃ বর্তমান সময়ে প্রচলিত নেতৃত্বে বিভিন্ন ধরন প্রতিফলিত হচ্ছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ তাদের আলোচনায় বিভিন্ন ধরনের নেতৃত্বের কথা বলেছেন। যথাঃ
১। স্বৈরতান্ত্রিক প্রভুত্বমূলক নেতৃত্ব
২। গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব
৩। অনানুষ্ঠানিক নেতৃত্ব
৪। আনুষ্ঠানিক নেতৃত্ব
৫। ব্যক্তিগত নেতৃত্ব
৬। আমলাতান্ত্রিক নেতৃত্ব
৭। ক্যারিজম্যাটিক নেতৃত্ব
৮। অবাধ নেতৃত্ব
নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ নেতৃত্ব তত্ত্ব প্রস্তাবনাঃ আমার মতে, নেতৃত্ব হলো নেতা তৈরি করার প্রক্রিয়া। ফলে, প্রাথমিকভাবে নেতা নির্বাচিত হবে অনুগামী নেতৃত্ব তত্ত্ব দ্বারা। আর নেতার নেতৃত্বের সময়সীমা নির্ধারিত হবে আচরণভিত্তিক নেতৃত্ব তত্ত্ব দ্বারা। এ তত্ত্ব অনুসারে নেতা কোন বিশেষ কোন লোক নন বরং নির্দিষ্ট একজন অনুসারী যিনি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য অনুসারীদের দ্বারা নির্বাচিত হবেন অনুসারীদের মুখপাত্র হিসেবে। এক্ষেত্রে নেতা কোন বিশেষ সুবিধা পাবেন না বরং তার দায়িত্ব থাকবে অনুগামীদের চেয়ে বেশি। নেতা সব সময় অনুগামীদের মাঝে বিশ্বাসযোগ্য থাকবেন। অনুগামীদের যেকোন প্রশ্নের জবাব দিতে নেতা সর্বদা বাধ্য থাকবেন। এ তত্ত্ব অনুসারে নেতা ও অনুসারীদের মাঝে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে শতভাগ। এতে কর্মবিভাজনের ব্যবস্থা থাকবে। নেতা কর্তৃক বিভাজিত কর্মের দায়িত্বপ্রাপ্ত অনুসারীগণ অন্যান্য অনুসারীগণের সহায়তায় কাজ সম্পাদন করবেন। এক্ষেত্রে নির্বাচিত অনুসারীগণের পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে নিজস্ব সৃজনশীলতা বিকাশের। কাজটি সম্পন্ন হলে তার প্রশংসা ও জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে অনুসারীগণকে। নেতা কাজগুলো তত্ত্বাবধায়ন করবেন ও বিভিন্ন বিষয়ে প্রস্তাবনা প্রদান করবেন। কিন্তু প্রস্তাবনা গ্রহণের ইচ্ছা নির্ভর করবে অনুগামীগণের উপর যারা ঐ কাজের জন্য নির্বাচিত হবেন। কোন নীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় গণতান্ত্রিক রীতি অনুসৃত হবে। নেতা সংখ্যাগরিষ্ঠ ফলাফল ঘোষণা করবেন এবং মানসম্মত সিদ্ধান্তের প্রতি যুক্তি প্রদান করতে পারবেন। অর্থাৎ, এক্ষেত্রে বহু স্তর বিশিষ্ট নেতৃত্ব চর্চা হবে। দলকে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত করে তাতে নেতৃত্বের চর্চা করবে অনুসারীরা যারা নেতার পর্যবেক্ষণ থেকে নির্বাচিত হবে বা অনুসারীদের ভোটে নির্বাচিত হবে। নেতৃত্ব রীতি হিসেবে অনুসরণ করা হবে অবাধ নেতৃত্বকে আর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অনুসরণ করা হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। নেতার সময়সীমা থাকবে অল্প। অর্থাৎ ৪ বা ৬ মাস পর পর নেতা পরিবর্তিত হবে। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে আচরণভিত্তিক অনাস্থা জ্ঞাপিত হলে নেতাকে তার নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে জাপানে প্রচলিত Sophisticated Leadership-এর সম্মিলন সাধিত হবে। কর্ম সম্পাদনের ক্ষেত্রে Art of Delegation-কে অনুসরণ করা হবে যেন নেতাকে সব ধরনের কাজের বোঝা মাথায় না নিতে হয়। নেতার কাজ থাকবে মূলত মানসিক তথা কাজের পরিকল্পনা, দূরদর্শিতা মূল্যায়ন, SWOT Analysis, কাজের প্রয়োগমুখিতা ইত্যাদি বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ করা। কাজ বাস্তবায়নের মাত্রা নির্ভর করবে নির্বাচিত অনুসারীবৃন্দের উপর। মোট কথা জন্মগতভাবে কেউ নেতা বা কেউ অনুসারী হয়ে আসতে পারে না বরং অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান-দক্ষতাই তাকে নেতার আসনে আসীন করে। তাই, বিভিন্ন নেতৃত্ব মডেল ও রীতির সমন্বয়ে নেতা চাইবেন তার প্রতিরূপ বা তার জায়গায় বসার মত একজনকে তৈরি করে যেতে আর অনুসারীরা পরিকল্পনা মাফিক কাজকে বাস্তবায়নের বিষয়টি দেখবে। তবে, এক্ষেত্রে নেতা যদি স্বজনপ্রীতি প্রদর্শন করে তবে এ মডেলটি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই, জন্মগত সুবিধাকে বাতিল করে এক্ষেত্রে জ্ঞান, দক্ষতা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে নেতা নির্বাচিত করতে হবে। জন্ম দিয়ে মানুষকে বিচার করার পুরাতন রীতি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ও বৈষম্যপূর্ণ। তাই, কাজ সম্পাদন ও অনুসারীদের প্রতি পূর্ণ ইতিবাচক ব্যবহারকারীরাই নেতা হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য। এক্ষেত্রে নেতা তার যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচিত করে নেতৃত্ব থেকে অব্যহতি নেবেন। তাই, সেই নেতাই সফল যিনি তার প্রতিরূপ সহজেই অল্প সময়ে তৈরি করতে পারবেন। অন্যান্য জায়গায় নেতা তার নেতৃত্ব আঁকড়ে ধরে থাকার মনোভাব প্রদর্শন করতে পারলেও এক্ষেত্রে নেতার নেতৃত্ব ছাড়ার মাঝেই অন্তর্নিহিত হবে তার সাফল্য। ফলে, তরুণ নেতৃত্ব উঠে আসবে ঠিক সময়ে। আর নেতৃত্বের স্বাদ গ্রহণ সকলের পক্ষেই সম্ভব হবে। নামকরণের ক্ষেত্রে বলা যায়, এ তত্ত্বটির নাম হতে পারে অনাত্মীয় উত্তরাধিকারমূলক নেতৃত্বের তত্ত্ব।
অনাত্মীয় উত্তরাধিকারমূলক তত্ত্বের সবল দিকঃ
১। এটি অনুসারীকেন্দ্রিক তত্ত্ব।
২। এতে নেতা সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী নন।
৩। যোগ্যতাভিত্তিক নেতৃত্বের স্বাদ সবারই অল্প সময়ে পাওয়ার সুযোগ আছে এতে।
৪। এতে নেতা আচরণের ভিত্তিতে টিকে থাকেন। সুতরাং, অনুসারীরা সর্বোচ্চ ভালো ব্যবহার আশা করতে পারবেন।
৫। এক্ষেত্রে নেতা ও অনুসারীদের মাঝে কোন কঠিন ভেদরেখা থাকে না বললেই চলে।
৬। এক্ষেত্রে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা সর্বোচ্চ মাত্রায় রক্ষিত হবে।
৭। এতে কর্ম বিভাজন হবে খুবই সতর্কতার সাথে। অর্থাৎ, কাজ ভাগ করার সময় নিজস্ব চাহিদা, ভালো লাগা ও একঘেঁয়েমিতার প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা হবে।
৮। নিজস্ব সৃজনশীলতা বিকাশে এটি সহায়ক।
৯। অনুসারীরা নিজস্ব ক্ষেত্রে কাজ করার বিষয়ে স্বাধীনতা ভোগ করবেন।
১০। নেতার কাছে অনুসারীরা নির্দ্বিধায় নিজস্ব মতামত বা প্রস্তাবনা ও বিরুদ্ধাচরণ (গঠনমূলক ও যৌক্তিক) প্রদর্শন করতে পারবে।
১১। অবাধ নেতৃত্ব বা গণতান্ত্রিক চর্চা পরোক্ষভাবে অনুসারীদের মাঝে নেতৃত্ব গুণাবলির চর্চা অব্যাহত রাখবে।
১২। নেতার সময়সীমা কম থাকবে বলে সে যথেচ্ছাচার করতে পারবেন না। আর তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে অনুসারীদের ভালো করায় মনোযোগ দেবেন।
১৩। যিনি নেতা হবেন, তিনি মাঠ পর্যায়ের ও মানসিক পরিশ্রম দুটোতেই দক্ষ হবেন।
১৪। জন্মগত বৈষম্য নয়, এক্ষেত্রে সব অনুসারীরই নেতা হওয়ার সুযোগ থাকবে।
১৫। এতে নেতা তার কর্মস্থল ইচ্ছাকৃতভাবে দীর্ঘ করতে চাইবেন না, কারণ তা তার ব্যর্থতা হিসেবে পরিগণিত হবে।
অনাত্মীয় উত্তরাধিকারমূলক তত্ত্বের দুর্বল দিকঃ
অনাত্মীয় উত্তরাধিকারমূলক তত্ত্বের দুর্বল দিকগুলো নিম্নরূপঃ
১। এতে প্রথাগত নেতৃত্ব তত্ত্বের মত নেতা প্রত্যয়টির ক্ষমতা নেই।
২। এক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমিকভাবে নেতা হিসেবে সবচেয়ে অপেক্ষাকৃত অযোগ্য লোকও নেতা হতে পারবেন।
৩। অনুসারী সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতার মেকি লোক দেখানো ভালো আচরণ দ্বারা প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা একটু হলেও থাকে।
৪। নেতা ও অনুসারীর পার্থক্য খুবই কম বলে এতে নেতা অনুসারী কর্তৃক ছোট অবাঞ্ছিত কারণে লাঞ্ছিত হতে পারেন।
৫। এক্ষেত্রে সৃজনশীলতা প্রকাশের নামে স্বেচ্ছাচারিতা চলতে পারে, যা ঐ সংগঠনের জন্য হুমকিস্বরূপ।
৬। নিজস্ব ক্ষেত্রে স্বাধীনতাকে অপব্যবহার করে অনুসারীরা তাদের আলসেমির প্রমাণ দিতে পারে যা সার্বিক কাজের ক্ষয় সাধন করতে পারে।
৭। অনুসারীদের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে যৌক্তিকতা বা সর্বজনীনতার চেয়ে ব্যক্তিগত অসুবিধা বেশি প্রাধান্য পেতে পারে।
৮। অবাধ নেতৃত্ব অরাজক পরিবেশ সৃষ্টি ও গণতান্ত্রিক চর্চা অশিক্ষিত ও বিবেকহীনদের মাঝে চর্চিত হলে খারাপেরই জয় হবে।
৯। নেতার সময়সীমা কম থাকবে বলে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বড় একটি গর্হিত কাজ করে ক্ষমাপ্রদর্শনপূর্বক অব্যাহতি নিতে পারেন যা সমস্ত সংগঠনের জন্য হঠাৎ বিপদ ডেকে আনবে।
১০। সব অনুসারীর নেতা হওয়ার সুযোগ অনেকের প্রতিযোগিতামূলক ব্যক্তিগত উন্নয়নকে মন্থর করে দিতে পারে। আবার ক্ষুদ্র সময়সীমা নেতার মনে বিরূপ প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে।
অনাত্মীয় উত্তরাধিকারমূলক নেতৃত্ব তত্ত্বের জন্য সুপারিশঃ
অনাত্মীয় উত্তরাধিকারমূলক নেতৃত্ব তত্ত্বের জন্য সুপারিশগুলো নিম্নরূপঃ
১। ‘নেতা’ প্রত্যয়টির সম্মানবোধের জায়গা দৃঢ় করা
২। নেতাকে যোগ্যতার সাথে সাথে গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করার দিকে মনোযোগী হওয়া
৩। নেতার সামাজিক ও ব্যক্তিগত মূল্যবোধ সুস্থিত ও সুন্দর করা
৪। নেতার ও অনুসারীদেরকে নিজ নিজ অহংবোধের বলয় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করা
৫। কাজের প্রতি অনুসারীদের অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসা ও দায়িত্বশীলতা সৃষ্টি করা
৬। ব্যক্তিস্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে সামষ্টিক স্বার্থে কাজে নামার মত মানসিকতা অনুসারী কর্তৃক অর্জন
৭। অনুসারী ও নেতা উভয়পক্ষকেই সুশিক্ষিত, স্বশিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান হতে হবে।
৮। নেতার পরিকল্পনা ব্যতিরেকে কাজের নেশাকে জীবনব্যাপী ব্রত করা
৯। নেতাকে পরিস্থিতি অনুযায়ী কোমল ও কঠোর হওয়ার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
১০। নেতাকে হতে হবে নিজের জায়গায় বসানোর মত অনুসারী তৈরির দিকে মনোযোগী আর অনুসারীদের দায়িত্ব হবে অতি আবেগিক না হয়ে যৌক্তিকতার নিরিখে বিষয়বস্তু বিচারের মানসিকতাসম্পন্ন।
আমার জীবনের অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবক ও অর্থকরী সংগঠনের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্ব নিয়ে করা শিক্ষায় নীতি, কৌশল ও নেতৃত্ব কোর্স থেকে আহরিত জ্ঞানের তাত্ত্বিকতা মিশ্রিত স্বতন্ত্র চিন্তার প্রতিফলন নেতৃত্ব সংক্রান্ত ‘অনাত্মীয় উত্তরাধিকারমূলক নেতৃত্ব তত্ত্ব’টি। তাত্ত্বিকভাবে এটি বেশ কষ্টসাধ্য বলে মনে হলেও দুটি সংগঠনে এটির পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বর্তমানে চলছে। এ সংগঠন দুটির একটি হল ‘ধনবাড়ী ইয়ুথ ক্লাব’ আর দ্বিতীয়টি হলো ‘অভয়ারণ্য (Sanctuary)। এদের প্রথমটির বর্তমান সভাপতি এবং দ্বিতীয়টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আমি নিজে। আশার বিষয় হলো, দুটি সংগঠনেই তত্ত্বটি বেশ ভালো ফলাফল প্রদর্শন করছে। যদিও দুটি সংগঠনই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, তবু পরবর্তীতে কোন অর্থকরী সংগঠনের নীতি নির্ধারণী জায়গায় বসার সামর্থ্য হলে এ তত্ত্বটির প্রয়োগে ঐ পরিবেশে এর কার্যকারিতে মূল্যায়নের একান্ত ইচ্ছা আমার রয়েছে। আশা করি, উপর্যুক্ত সুপারিশসমূহ ঠিকভাবে পালন করা হলে এ তত্ত্বটি সব জায়গায়ই নেতৃত্ব তৈরি ও নেতৃত্বের সুপ্ত প্রতিভা অন্বেষণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

শামীম আল মাহমুদ (শিমুল)
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, অভয়ারণ্য (Sanctuary)

(ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের উপানুষ্ঠানিক ও অব্যাহত শিক্ষা বিভাগের শিক্ষায় নীতি, কৌশল ও নেতৃত্ব কোর্সের আরোপিত কাজ হিসেবে অধ্যাপক আজহারুল ইসলামের কাছে ২ মে ২০১৬ তারিখে জমাকৃত)

মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০১৯

'বিনিময়’ উন্নয়নে ৬ দফা


সাধারণভাবে বলা হয়, রাজধানী ঢাকা হতে যতই উত্তরে যাওয়া হয় ততই মানুষ সরল থেকে সরলতর হয় আর যতই দক্ষিণ দিকে যাওয়া হয় ততই চালাক লোকের দেখা মেলে। ভৌগোলিকভাবে ধনবাড়ী উপজেলা ঢাকা বিভাগের সর্ব উত্তরের উপজেলা। তাই, এখানকার মানুষজন বেশিরভাগই সহজ-সরল। তবে, সহজ-সরলতার জন্য উত্তরবঙ্গের মানুষজনকে এমনকি আমরাও ‘মফিজ’ বলতে দ্বিধা করি না। যদিও জন্ম দিয়ে মানুষকে বিচার করা উপমহাদেশীয় আদি বদ অভ্যাস, উপরন্তু অতীত গর্বে মজে বর্তমানকে অস্বীকার করাও এক আভিজাত্য হিসেবে স্বীকৃত। কিন্তু, যাদের আমরা ‘মফিজ’ সম্বোধনে অভ্যস্ত, তাদের গণপরিবহনের অবস্থা অবলোকন করেছেন কি? যদি মনোযোগ দিয়ে দেখেই থাকেন তবে আমাদের গণপরিবহনের সাথে তুলনা করুন। আশা করি, তথাকথিত ‘মফিজ’দের গণপরিবহনের অবস্থা যদি ‘সড়ক পথে বিমানের ছোঁয়া’ হয়, তবে তার চেয়ে কয়েক গুণ বাজে সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট আমাদের উপাধি কি হতে পারে, একবার নিজে নিজেই চিন্তা করুন।
আগেভাগেই বলে নেই, আমি বিনিময়ের নিন্দুক তো নইই বরং শুভাকাঙ্ক্ষী। শিক্ষার উদ্দেশ্যে কসমোপলিটন মেগাসিটি ঢাকার রাস্তায় যখন ‘বিনিময়’ বাস দেখি, তখন নিজের অজান্তেই ‘বিদেশে নিজ এলাকার কুকুর দেখলেও নাকি আপন মনে হয়’ কথাটির সত্যতা হাড়ে হাড়ে টের পাই। কিন্তু, নিজ এলাকার ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা যখন একযোগে এর তীব্র সমালোচনা করে, তখন আমার নিজেরই খুব কষ্ট হয়। তাই, বিনিময়কে একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক আন্তঃজেলা গণপরিবহনে পরিণত করার জন্য আমার এই কি-বোর্ডে হাত চালানো। ‘আমরা ধনবাড়ীবাসী’ নামক ধনবাড়ীর সবচেয়ে বেশি মানুষের ভার্চুয়াল কোলাহলমুখর ফেসবুক গ্রুপে ‘বিনিময়’ সংস্কার নিয়ে খোলা পোলের ভোট অনুযায়ী নিচে ‘বিনিময়’ সংস্কারের ৬ দফা প্রস্তাবনা দেওয়া হলো। সুতরাং, এটি শুধু আমার ব্যক্তিগত মতামত নয় বরং এ অঞ্চলের অনেকের চাহিদার সম্মিলিত প্রতিফলন।
১। দূরত্ব (ধনবাড়ী বাসস্ট্যান্ড থেকে মহাখালী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনাল পর্যন্ত ১৫০ কিমি) ও তেলের মূল্য অনুযায়ী একটি দীর্ঘস্থায়ী ভাড়া স্থির করা, যা ঈদ কিংবা অন্যান্য উৎসব বা লম্বা ছুটির পর অযৌক্তিকভাবে বাড়বে না। স্বজনপ্রীতি কিংবা প্রভাব-প্রতিপত্তি অনুযায়ীও এটি যেন নড়চড় না হয় তার জন্য কম্পিউটারাইজড টিকেট কাটার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বর্তমানে ধনবাড়ীর মানুষের যে ক্রয়ক্ষমতা, তাতে তারা বাস ভাড়া বাড়লেও ভ্রমণ করবে, কিন্তু সেবার সাথে কোন ধরনের আপোষ করবে না।
২। ভাড়া নির্ধারণের সাথে সাথে প্রথম স্টপেজ থেকে শেষ স্টপেজ পর্যন্ত প্রতিটি স্টপেজে পৌঁছানোর সময় নির্ধারণ করা। এক্ষেত্রে, বাসের আইনসিদ্ধ গতি এবং দূরত্বই হবে সময় নির্ণায়ক মানদণ্ড। গুগল ম্যাপ অনুযায়ী ধনবাড়ী থেকে টাঙ্গাইল মহাসড়ক ধরে মহাখালী পর্যন্ত যেতে আনুমানিক সময় লাগার কথা ৪ ঘণ্টা ১৪ মিনিট (ট্র্যাফিক ছাড়া ৩ ঘণ্টা ৩২ মিনিট)। তবে, যানজটের কারণে যদি সময় ৬ ঘণ্টার বেশি লাগে, তবে যাত্রীদের জন্য হালকা নাস্তার ব্যবস্থা করা। কেননা, মানুষের খাবার হজমের গড় সময় ৬ ঘণ্টা বলে অনেক বাসেই এখন এ সেবা খুবই স্বাভাবিক, রোজা-রমজান হলে তো কথাই নেই।
৩। একজন মানুষের পানি পরিপাক করে রেচনক্রিয়া সম্পন্ন হতে গড়ে ২ ঘণ্টা লাগে। তাই, বাসে দীর্ঘ সময়ের চলাচলে অন্তত ২বার সবার জন্য স্বাস্থ্যসম্মত ওয়াশরুম ব্যবহারের জন্য ৫ মিনিট করে যাত্রাবিরতি দিতে হবে। বিশেষ করে, নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য এটি একটি অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যনীতি। এটি না করলে কিডনিতে পাথর, প্রস্রাবে প্রদাহ বা ক্যান্সারের মত যেসব দুরারোগ্য রোগ হতে পারে, তার দায়ভার পরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের বহন করা উচিৎ।
৪। বিশেষত রাতের বাসের দূরবর্তী স্থান থেকে আগত নারী যাত্রীদের জন্য আধুনিক সুযোগসুবিধাসম্পন্ন যাত্রী ছাউনী নির্মাণ করতে হবে। যাত্রী ছাউনীতে যাত্রীর জান-মালের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫। নামে নয় ‘বিনিময়’কে কার্যত সিটিং সার্ভিসে রূপান্তরিত করতে হবে। বাড়ী বাড়ী গিয়ে দাওয়াত দেওয়ার মত যাত্রী জোগাড়ের যে বদনাম রয়েছে, তা অবশ্যই ঘুচাতে হবে। এতে সবচেয়ে দামী সম্পদ সময়ের প্রচণ্ড অপচয় হয়। এছাড়াও কোন অবস্থাতেই (পিক কিংবা অফ-পিক সিজনে) দাঁড়ানো যাত্রী নেওয়া যাবে না।
৬। অভিজ্ঞতার পাশাপাশি চালক নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতা ও মাদকাসক্তিহীনতাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এছাড়াও হেল্পার ও সুপারভাইজরদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করতে হবে। দরকার হলে তাদেরকে নিয়োগের পর পূর্ণ পেশাদারিত্ব অর্জনের জন্য স্বল্পমেয়াদী প্রশিক্ষণের সুবিধা প্রদান করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা ও শ্লীলতাহানীর মত ন্যাক্কারজনক কোন ঘটনা ঘটলে জনসমক্ষে স্টাফদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
আধুনিক যুগ হচ্ছে বাজারজাতকরণের যুগ। তাই, সর্বোত্তম পণ্যেরও প্রচার না করলে তা ক্রেতা হারায়। অপরদিকে, সিটিজেন জার্নালিজমের সহজলভ্যতায় যেকোন ঘটনা ঘটার সময়ই তার খবর অন্যদের দোরগোড়ায় পৌঁছে যায়। তাই, ‘বিনিময়’-এর জনপ্রিয়তা বাড়াতে এর যাত্রীসেবা বাড়ানো ছাড়া কোন উপায় নেই। কারণ, মনে রাখতে হবে, এক সময়ের বিকল্পহীন ‘বিনিময় প্রথা’ও কিন্তু কালের বিবর্তনে বাতিল হয়ে গেছে।

(অভয়ারণ্য প্রকাশনার স্বাধিকার সংখ্যা 'অসহযোগ'-এ প্রকাশিত) 

রবিবার, ৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৯

পাঠকের পাঠ্যাভাসের প্রয়োজনীয়তা


‘ধুর! কি যে লিখছে, বোঝাই যায় না!’ এরকম কথা আমি হরহামেশাই শুনি অনেক পাঠকের মুখ থেকে। অবশ্য যেদেশের গড় সাহিত্য আস্বাদনের সর্বোচ্চ নিদর্শন কতগুলো হাতে গোনা জনপ্রিয় রচনাবলিতে, সে দেশের বেশিরভাগ পাঠকের কাছ থেকে এরকম দোষারোপ করাটাই স্বাভাবিক।
পা দিয়ে ঠকে যে, তিনিই নাকি পাঠক। তবে একথাও ঠিক যে, পাঠকই লেখকের সরাসরি প্রাথমিক মূল্যায়নকারী। অবশ্য আমাদের দেশে স্কুল-কলেজের সাহিত্যের ক্লাসগুলো শুধু পড়া আদায় করাতেই সীমাবদ্ধ, পড়ানোতে নয়। তাই কোন রচনার নামকরণের সার্থকতা কিংবা মর্মবাণী শিক্ষার্থীরা আত্মস্থ করতে পারে না। বরং বিভিন্ন গাইডে অন্যের মতামত তারা তোতাপাখির মত মুখস্থ করে তা পরীক্ষার খাতায় লেখাতে পারদর্শী হয়। ফলে সাহিত্যের মত একটি নান্দনিক বিষয়ে মানুষের আগ্রহ কমতে কমতে এমন হয় যে, উচ্চশিক্ষায় যারা সাহিত্য নিয়ে পড়ে তারা বেশিরভাগই বাধ্য হয়েই তা গিলতে বাধ্য হয়।
শুনেছি প্লোটো এবং তাঁর প্রিয় শিষ্য এরিস্টটল নাকি দুধরনের লোকের জন্য দুভাবে বই লিখেছিলেন। অপেক্ষাকৃত কম বোঝা মানুষের জন্য সহজভাবে আর অপেক্ষাকৃত ভালো বোঝা মানুষের জন্য কঠিনভাবে তাঁরা লিপিবদ্ধ করেছেন দার্শনিক তত্ত্বসমূহ। কিন্তু কালের বিবর্তনে এরিস্টটলের সহজভাবে লেখা রচনাগুলোই টিকে যায়। অপরদিকে নিজের প্রস্তাবিত আদর্শ রাষ্ট্রে কবিদের প্রবেশাধিকার না রাখলেও, জাতকবি প্লেটোর কঠিনভাবে লেখাটিই হয়ে ওঠে কালোত্তীর্ণ।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঘোষণা করেছেন, ‘সত্য যে কঠিন, / কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, / সে কখনো করে না বঞ্চনা।’ আবার কবিদের কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘কিছুই সহজ নয়’ কবিতায় গেয়ে ওঠেন, ‘সহজ আনন্দ ছিল কিসে, মনেও পড়ে না। / জীবনের দেনা শুধু বাড়ে চক্রবৃদ্ধি হারে; / শুধিতে পারি না ঋণ, বুঝি সহজ ছিল না রাত্রি, / ছিল না সহজ কোনদিন।’
বস্তুত, আমরা যা পারি না তাই আমাদের কাছে কঠিন। ব্যাপারটি আপেক্ষিক এবং ব্যবহারকারীভেদে পরিবর্তনশীল। ধরুন একজন সব্যসাচী ব্যক্তি সবকিছুই ভালোভাবে করতে পারেন কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাইসাইকেল চালাতে পারেন না। তবে, তার কাছে ব্যক্তিগত গাড়ি চালানোর চেয়ে বাইসাইকেল চালানো বেশি কঠিন বলে মনে হবে।
তাই, যখন কাউকে অবলীলায় রবীন্দ্রনাথ কিংবা জীবনানন্দ দাশের নেতিবাচক সমালোচনা করে তখন আমারও যীশু খ্রিস্টের মত মনে হয়, 'ঈশ্বর, ইহাদিগকে (যারা তাকে ক্রুশবিদ্ধ করেছে) ক্ষমা করো; কেননা ইহারা কি করিতেছে তাহা জানে না।' আসলে এই অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী জ্ঞানসম্পন্ন লোকজনের নেতিবাচক মূল্যায়ন জীবনানন্দ কিংবা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক মূল্য কোনভাবেই কমাতে পারে না। তবে ধারাবাহিক অজনপ্রিয়তা অনেক সময় জীবনানন্দ বা ভ্যান গগের মত ধারা তৈরিকারী মহান শিল্পীকেও ঠেলে দিয়েছে হতাশার তলানীতে। তাই, দার্শনিক কান্টের মত আমারও মাঝে মাঝে মনে হয় যে, মানুষকে অল্প ভুলেও বেশ শাস্তি দেওয়া উচিৎ।
মূলত, জনপ্রিয় হওয়া মানে বেশিরভাগ মানুষের সাথে মতের মিল হওয়া। কিন্তু যখন আপনি সমাজে বা রাষ্ট্রে নতুন কিছু আনছেন তখন তা বর্তমান লোকজনের চিন্তার সাথে না মেলাই স্বাভাবিক। তাই যুগ পরিবর্তনকারী শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের অজনপ্রিয় হওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। তাই হাওয়ার বিপরীত তালে চলে তারা হন গণতান্ত্রিক ভুলের বলি। অনেক ক্ষেত্রে অনেকে হন নির্বাসিত বা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত। এর উদাহরণ স্বয়ং সক্রেটিস।
তাই, বর্তমানে সহজ আর জনপ্রিয়কে এক কাতারে দাঁড় করানো যায়। কিন্তু, হুমায়ুন আজাদের মতে, ‘জনপ্রিয়তা হচ্ছে নেমে যাওয়ার সিঁড়ি। অনেকেই আজকাল জনপ্রিয়তার পথে নেমে যাচ্ছে।’ তাই, যা কিছু সহজ না, তাকে হুট করে খারাপ বলার অভ্যাস পরিত্যাগ করুন। লেখকের ক্ষেত্রে তো অবশ্যই, পাঠক হিসেবে আপনি আপনার জ্ঞানের পরিধি বাড়ান, দেখবেন কঠিনের মাঝেও পুষ্প ফুটছে অহর্নিশ। নচেৎ, আপনাকে ঘুরতে হবে গড় পাঠক হয়ে সাধারণ বইয়ের সাময়িক জ্ঞানের বৃত্তে।
শেষ করবো সুনীলের নীরাকে দিয়ে। নীরা একদিন আমাকে বললো, ‘তোমার জীবনে দরকার সহজ-সরল এক মেয়ে, যে কঠিন কথা শুধুই শুনে যাবে। তাহলে কোন দাম্পত্য দ্বন্দ্ব হবে না।’ আমি স্মিত হেসে বলি, ‘দ্বন্দ্ব ছাড়া গতি হয় না, গতি ছাড়া দ্বন্দ্ব হয় না।’

বৃহস্পতিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৮

নির্বাচন ও রাজনীতিঃ আমরা কেন ভোট দেবো?



এরিস্টটলের ভাষায় ‘মানুষ রাজনৈতিক জীব।‘ তাই আমরা চাই বা না চাই আমরা জন্মগতভাবেই ভাল-মন্দ উভয় রাজনীতির শিকার। আর ভোটাধিকার হচ্ছে একজন নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার। তাই, রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে ব্যক্তির অভিব্যক্তি, মতামত, প্রতিবাদ, দ্রোহ, ক্ষোভ, ভালোবাসা, ত্যাগ, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ আশা-প্রত্যাশার বহির্প্রকাশের প্রতিচ্ছবি হচ্ছে ভোট। সমাজে ব্যক্তির একটা অবস্থানও নির্ণীত হয় ভোটাভুটি কিংবা নানা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। ‘না ভোট’টাও কিন্তু প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে এক নীরব প্রতিবাদ, যদিও ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নাগরিকের সেই অধিকারটাকেও খর্ব করা হয়েছে। আজ যারা নিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে ব্যস্ততা, নানা সমস্যা, অসচেতনতাবশত কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় না কিংবা নিতে পারে না তারা এক অর্থে বঞ্চিত। কিংবা ভিন্ন থিওরি মাথায় আপলোড করে চলমান বিচ্ছিন্নতা বা বৈরী প্রতিবেশ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন না। এক্ষেত্রে প্রবীর ঘোষের সেই লাইনটা প্রণিধানযোগ্য ‘কোন অসুস্থ্ সমাজ ব্যবস্থায় সুস্থ্ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য।‘ বিদ্যমান সিস্টেম বদলানো কিংবা উন্নতি-অবনতির প্রাসঙ্গিকতায় যাদের নিষ্ক্রিয় অবস্থান, এই শ্রেণির মানুষগুলোর অপর নাম ‘নিরীহ’, ‘নিরপেক্ষ', 'রাজনীতি উদাসীন', 'সাঃ আমজনতা'যাদের মুখ থেকেই বেশি শোনা যায় ‘রাজনীতির মধ্যে যাইয়ো না,' 'কী অইবো ভোট দিয়া', 'অত গ্যাঞ্জামের মধ্যে যাইয়ো না', 'প্রতিবাদ কইরা লাভ নাই', 'নিজে ভালা থাকলেই জগৎ ভালা', 'ওইখানে আমার তো কোন লাভ নাই আমি যামু ক্যা', 'যা মুনে অয় তাই হউকগা, তাতে তোমার কী' ইত্যাদি মানুষকে আলটিমেটলি নিরুৎসাহিত-স্তব্দ-নিষ্ক্রিয় করার ঔচিত্যমূলক অমৃত বচন! সমাজে এই মানুষগুলোই সবচেয়ে অসহায়, শোষিত-বঞ্চিত-লাঞ্চিত হয়ে আসছে অতীতে-বর্তমানে এমনকি ভবিষ্যতেও হবে। কেননা, আমাদের সমগ্র জীবন তথা ভোর থেকে রাত, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত ব্যবহার্য জিনিসপত্র, মৌলিক বিষয়াবলি, বাজারের পণ্য, চাল-ডাল-তেল-নুন-গ্যাস-বিদ্যুৎ, এসবের প্রকৃত বা ন্যায্য মূল্যের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, এলাকাস্থ মানুষ-আত্মীয়-বন্ধু-উপরতলা-নিচতলার মানুষের সাথে অপর মানুষের সম্পর্কগুলোও ক্ষমতাতান্ত্রিক রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত। কেননা, এসব কিছুই রাজনীতি তথা ব্যবসায়ীদের দ্বারা নির্ণীত ও নিয়ন্ত্রিত। মানুষ ক্ষমতার পূজারী, তাই ক্ষমতাতন্ত্রের আশেপাশে থেকে রাজনৈতিক সুবিধাদি ভোগ করে ঐ 'নিরীহ' শ্রেণির 'সাধারণ জনতা'কে হারিয়ে-ঠকিয়ে-ভয় দেখিয়ে-লোভ দেখিয়ে-চাপ প্রয়োগ করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কোন পক্ষে যাবো- ডোমিনেট করবো নাকি ডোমিনেটেড হবো? সবহারাদের দলে নাকি সর্বহারাদের উদ্ধার করে বিদ্যমান অচলায়তনে পরিবর্তনকামী-কর্মীদের দলে? সচেতনদের দলে নাকি অচেতনদের দলে? সেই সাথে বর্তমান সময়ে আরও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন-পাকপন্থী রাজাকারদের পক্ষে নাকি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে? চেতনাধারীদের পক্ষে নাকি চেতনাহীনদের পক্ষে নাকি চেতনা ব্যবসায়ীদের পক্ষে? সিদ্ধান্তটা আপনার। একেকটা নির্বাচন মানে রাষ্ট্রের ক্রান্তিকালীন সময়। এসময় আপনাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে সচেতনচিত্তে। বিন্দুমাত্র অবচেতন আর চৈতন্যহীনতার সুযোগে দেখবেন একদিন পরিবার-সমাজে-এলাকায়-রাষ্ট্রে আপনার চিহ্নমাত্র নেই। আপনার নিজ জীবন, গৃহ, পরিবার-পরিজন, ভাই-বোন-সন্তান, আপনার ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার, চাকরি-ব্যবসা, প্রতিষ্ঠান এমনকি অপরজনার সাথে সম্পর্কও নিরাপত্তাহীনতার চাদরে ঢাকা পড়বে; যেথায় একটু ঝড়ো বাতাসে (কারও থ্রেটে) উড়ে যাবে, হালকা বৃষ্টিতে (ফাঁপর) ভিজে চুপসে যাবে। দেখবেন, আপনি বেঁচে আছেন অথচ সমাজ ও জাতীয় নিবন্ধন তালিকা হতে আপনার নামটিও উধাও হয়ে গেছে। ভোট দিতে এসে দেখবেন আপনার ভোট অন্য কেউ দিয়ে গেছে অথচ আপনার বলার-প্রতিবাদের ভাষা নেই, কারণ আপনি মেরুদণ্ডহীন 'নিরীহ-অসচেতন' মানুষ নামের মস্তিষ্কহীন জীব। অমুক বলে কেউ একজন আছে/ ছিল এটা মানুষ ভুলে যাবে, আর আপনি হয়ে যাবেন এই একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবী নামক গ্রহের বাংলাদেশের হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির প্রাণী। সুতরাং, ব্যক্তি তথা নিজ প্রয়োজনেই প্রত্যেকেরই রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। আর সেটার প্রতিফলন হোক একটা সুষ্ঠু-স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভোট দানের মাধ্যমে। স্বাধীনতার ৪৮তম বিজয় দিবসে একটি সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়তে রাষ্ট্রীয় বাইবেল সংবিধান বর্ণিত ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’, ‘সমাজতন্ত্র ও শোষণ হইতে মুক্তি’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা’ এই চার মূলনীতি যিনি লালন-পালন ও ধারণ করেন এমন ব্যক্তিকেই ভোট দিন। রাষ্ট্রের মালিক যেহেতু জনগণ সেহেতু নির্বাচনে জনগণের দ্বারা জনগণের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হোক একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটাই একজন ভোটারের প্রত্যাশা।



* (অভয়ারণ্য (Sanctuary) কর্তৃক প্রকাশিত বিজয়োৎসব সংখ্যা 'পুনর্জন্ম'তে প্রকাশিত) 

বৃহস্পতিবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৮

মাদক, বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতন রোধে তারুণ্য


স্থান-কাল-পাত্র, জাতি-ধর্ম-বর্ণ, দল-মত-লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষের জীবনের সবচেয়ে সোনালী সময় হল যৌবনকাল। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে যে, যৌবনের প্রচণ্ড গতিবেগ ও অদম্য শারীরিক-মানসিক শক্তির রীতিমত অপচয় হচ্ছে। কেননা, যে বয়সে প্রতিটি যুবক-যুবতীর নিজের সৃজনশীল কাজের দ্বারা নিজের এলাকা কিংবা দেশকে সহজেই সারা বিশ্বের কাছে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব, সে সময় একজন তরুণ হয়তো অকালে শেষ হয়ে যাচ্ছে আসক্তির ফলে। অপরদিকে, একজন তরুণীকে বাল্যবিয়ে বা নারী নির্যাতনের শিকার হয়ে গুটিয়ে বাঁচতে হচ্ছে বাকীটা জীবন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই যে অসীম সম্ভাবনার অপব্যবহার হচ্ছে তা ইচ্ছাকৃত, অনেক ক্ষেত্রে তা অনিচ্ছাকৃত। তবে অদূরদর্শী সম্মতি বা অনিচ্ছাকৃত অবদমনে অজ্ঞাতসারে ক্ষতিটা কিন্তু হচ্ছে শেষমেষ পরিবার, সমাজ, দেশ কিংবা রাষ্ট্রের; যার ক্ষতিপূরণ দেওয়া এক কথায় অসম্ভব। তাই, এই মুহূর্তে এ তিন মহামারী রোগ থেকে সমাজকে সুস্থ করতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে বিশেষ করে তরুণদেরকে।
মাদকঃ মানুষ নেশার জন্য যা ব্যবহার করে তাই মাদক দ্রব্য। সেটি হতে পারে ইনজেকশন, ধূমপান বা যে কোন মাধ্যম। তাই বলা যায় যে, হিরোইন, কোকেন, ইয়াবা, আফিম, মারিজুয়ানা, গাঁজা, ফেনসিডিল, বিয়ার, কেটামিন, স্পিড, বিভিন্ন রকমের ঘুমের ওষুধ থেকে শুরু করে জুতা লাগানোর আঠা পর্যন্ত সবই মাদকদ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত। জাতিসংঘ মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (UNDCP) মাদকের যে সংজ্ঞা দিয়েছে তা হল Intoxication (N): It is the state that results from the intake of a quantity of a substance which exceeds the individual’s tolerance and produces behavioral and physical abnormalities. মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ (সংশোধিত ২০০৪) অনুযায়ী “মাদকদ্রব্য” অর্থ প্রথম তফসিলে উল্লিখিত কোন দ্রব্য এবং এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার কর্তৃক, সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, মাদকদ্রব্য বলিয়া ঘোষিত অন্য কোন দ্রব্য। এক্ষেত্রে ৩টি শ্রেণিতে মাদকদ্রব্যগুলোকে ভাগ করা হয়। ক-শ্রেণির মাদকদ্রব্য (হেরোইন, কোকেন এবং কোকা উদ্ভূত মাদকদ্রব্য, পেথিডিন, মরফিন ও টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল, অপিয়াম, ক্যানাবিস রেসিন বা অপিয়াম উদ্ভূত, মেথাডন ইত্যাদি), খ-শ্রেণির মাদকদ্রব্য (গাঁজা বা যে কোন ভেষজ ক্যানাবিস, ফেনসাইক্লিআইন, মেথাকোয়ালন এলএসডি, বারবিরেটস এ্যামফিটামিন, অথবা এইগুলির যে কোনটি দ্বারা প্রস্তুত মাদকদ্রব্য ইত্যাদি) এবং গ-শ্রেণির মাদকদ্রব্য। এছাড়া “মাদকাসক্ত” অর্থ শারীরিক বা মানসিকভাবে মাদকদ্রব্যের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তি বা অভ্যাসবশে মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারী। আবার, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১২) অনুসারে “তামাক” অর্থ কোন নিকোটিনা টাবাকাম বা নিকোটিনা রাসটিকার শ্রেণিভুক্ত উদ্ভিদ বা এতদ্‌সম্পর্কিত অন্য কোন উদ্ভিদ বা উহাদের কোন পাতা বা ফসল, শিকড়, ডাল বা উহার কোন অংশ বা অংশ বিশেষ। “তামাকজাত দ্রব্য” অর্থ তামাক, তামাক পাতা বা উহার নির্যাস হইতে প্রস্তুত যে কোন দ্রব্য, যাহা চোষণ বা চিবানোর মাধ্যমে গ্রহণ করা যায় বা ধূমপানের মাধ্যমে শ্বাসের সহিত টানিয়া লওয়া যায় এবং বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, গুল, জর্দা, খৈনী, সাদাপাতা, সিগার এবং হুক্কা বা পাইপের ব্যবহার্য মিশ্রণও (mixture) ইহার অন্তর্ভুক্ত। আর “ধূমপান” অর্থ কোন তামাকজাত দ্রব্যের ধোঁয়া শ্বাসের সহিত টানিয়া নেওয়া বা বাহির করা, এবং কোন প্রজ্বলিত তামাকজাত দ্রব্য ধারণ করা বা নিয়ন্ত্রণ করাও ইহার অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে দেশের মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়)। আরও ভীতিজনক তথ্য হলো, প্রতি ১৭জনে একজন তরুণ মাদকাসক্ত। UNDCP’র তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর বিক্রি হওয়া ইয়াবার মাত্র ১০% ধরা পড়ে। ২০১৬ সালে দেশে ২ কোটি ৯৪ লাখ ইয়াবা ধরা পড়ে যা মোট বিক্রির (৪০ কোটি) কিয়দংশ। আমাদের রাষ্ট্রীয় বাইবেল সংবিধানের ১৮তম অনুচ্ছেদ (জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা)-এ আমরা দেখতে পাই, (১) জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষতঃ আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷ (২) গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷ এছাড়াও অতি সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সাথে খেলোয়াড়দের মত ডোপ টেস্ট সংযুক্ত করার পরিকল্পনাটি নিঃসন্দেহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
বাল্যবিয়েঃ শিশু আইন, শিশুনীতিসহ বিভিন্ন আইন ও নীতি এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদসহ বিভিন্ন সনদ অনুসমর্থন করে সরকার ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তাই বলা যায়, ১৮ বছরের নিচের কোন নাবালিকাকে বিয়ে দেওয়াই (কারণ, তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়স হয় না) বাল্যবিয়ে। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০-এ বলা আছে “শিশু” অর্থ অনধিক ষোল বৎসর বয়সের কোন বালিকা। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৪ নামে আইনের খসড়ায়  উল্লেখ  আছে, ‘যুক্তিসংগত কারণে মা-বাবা বা আদালতের সম্মতিতে ষোলো বছর বয়সে কোনো নারী বিয়ে করলে সেই ক্ষেত্রে তিনি “অপরিণত বয়স্ক” বলে গণ্য হবেন না।’ এছাড়াও বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬ নামে আইনের খসড়ার ১৯ ধারায় আছে, এ আইনের অন্যান্য বিধানে যা কিছুই থাকুক না কেন বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশে এবং পিতা-মাতার সম্মতিতে বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বিয়ে হলে তা এই আইনে অপরাধ বলে গণ্য হবে না’। সুতরাং, আইন-আদালতের হিসেবে যাই থাকুক না কেন, ৬৪% বাল্যবিয়ে দেওয়া মেয়ের (প্রথম আলো, ৯-০২-’১৮) অকালে গর্ভধারণজনিত সংকট চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুযায়ী কিন্তু কোনক্রমেই কমে না।
নারী নির্যাতনঃ ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘ প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদনে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা/ নির্যাতন সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘নারী নির্যাতন এমন একটি নিন্দনীয় অপরাধমূলক কাজ যার ফলে নারী দৈহিক, মানসিক ও যৌন হয়রানির শিকার হয় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।’ নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গে জাতিসংঘের সংগঠন প্রণীত নারী নির্যাতনের বিভিন্ন রূপের তালিকা নিম্নরূপঃ
পরিবার
দৈহিক আগ্রাসনঃ হত্যা যৌতুক ও অন্যান্য, দৈহিক আঘাত ও প্রহার, যৌন অঙ্গহানি, ভ্রূণ হত্যা, শিশু হত্যা, খাদ্য বঞ্চনা, চিকিৎসা সেবায় বঞ্চনা, প্রজনন ঘাটতি বলপ্রয়োগ/ নিয়ন্ত্রণ, যৌন অত্যাচার, ধর্ষণ, মানসিক অত্যাচার, আটকে রাখা, বলপূর্বক বিবাহ দান, প্রতিশোধের ভীতি প্রদর্শন
সম্প্রদায়
(সামাজিকগোষ্ঠী, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি)-এর ভিতরে বা বাইরে নারীর উপর নির্যাতনঃ দৈহিক অত্যাচার, দৈহিক আঘাত ও প্রহার, দৈহিক শাস্তি প্রদান, প্রজনন ঘাটতি বলপ্রয়োগ/ নিয়ন্ত্রণ, ডাইনী দাহ, সতীদাহ, যৌন হামলা, ধর্ষণ
কর্মস্থলে নির্যাতনঃ যৌন আগ্রাসন, হয়রানি, ত্রাস/ ভীতি প্রদর্শন, নারী পাচার, জবরদস্তি পতিতাবৃত্তি
তথ্য মাধ্যমঃ অশ্লীল সাহিত্য, নারীদেহকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করণ।
গোষ্ঠী
রাজনৈতিক নির্যাতন (নীতি, আইন ইত্যাদি): বেআইনী আউট, জবরদস্তি সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা বিনষ্টকরণ, জবরদস্তি গর্ভধারণ, অরাষ্ট্রীয় এজেন্টদের নির্যাতন বরদাস্ত করণ।
হেফাজতে নির্যাতন (সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ইত্যাদি): ধর্ষণ, নিপীড়ন

নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডও সনদ তিনটি মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এগুলো হলঃ সমতা নীতি, বৈষম্যহীনতার নীতি এবং শরিক রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বের নীতি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯, ২৭, ২৮ (১), (২), (৩), (৪) ও ২৯ (১), (২) অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষের সম অধিকারের কথা বলা আছে। এছাড়াও ১০, ২৬নং অনুচ্ছেদে উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ফলে, প্রশাসনে ১ম শ্রেণিতে ১০ এবং ২য় শ্রেণিতে ১৫ শতাংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। জাতীয় মহিলা সংস্থার মতে, নির্যাতন দৈহিক হতে পারে বা মানসিক হতে পারে। কাউকে দৈহিক কষ্ট দেওয়া, কাউকে প্রহার করা কিংবা কাউকে মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া, কাউকে পদে পদে খোঁটা দেওয়া সবই নির্যাতন। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের যেসব রূপ হামেশাই দেখা যায় সেগুলো হলঃ ১. শারীরিক নির্যাতন, ২. ধর্ষণ বা বলৎকার, ৩. যৌন হয়রানি, ৪. এসিড নিক্ষেপ, ৫. তালাক, ৬. যৌতুকের বলী, ৭. মানসিক নির্যাতন, ৮. আর্থিকভাবে নির্যাতন, ৯. নারী পাচার, ১০. গণিকা বৃত্তি, ১১. অশ্লীল সাহিত্য, ১২. বিজ্ঞাপনে ও সুন্দরী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নারীকে পণ্যে পরিণতকরণ, ১৩. পরিবারে নারী নিগ্রহ, ১৪. অপহরণ, ১৫. উত্যক্ত করা বা মৌখিক নির্যাতন ইত্যাদি। নারীরা স্বামী বা সঙ্গী কিংবা সঙ্গী নন এমন পুরুষের দ্বারা শারীরিক ও যৌন উভয়প্রকার নির্যাতনের শিকার হন। এছাড়াও সঙ্গী দ্বারা মানসিক, অর্থনৈতিক এবং স্বামীর সাথে বয়স পার্থক্যের কারণজনিত নির্যাতনের শিকার হন। অপরদিকে সঙ্গী নন এরকম পুরুষ দ্বারা নির্যাতনের দৃষ্টিভঙ্গি, শৈশবে নির্যাতন, নারী সদস্য হিসেবে পরিবারে যৌন হয়রানি/ উত্যক্তকরণের অভিজ্ঞতার শিকার হন অনেক নারী। নারী নির্যাতন নিয়ে সরকারের প্রথম জরিপে দেখা যায় যে, ২০ থেকে ৩৪ বছর বয়সী নারীরা যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছেন। শহরের তুলনায় গ্রামে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে। এছাড়াও বাইরের মতো ঘরের ভেতরেও স্বামী ও অন্যান্য আপনজনের কাছেই নারী ঝুঁকির মধ্যে থাকেন এবং নির্যাতনের সম্মুখীন হন। বিয়ের আগেও প্রায় ৪২ শতাংশ ১৪ বছর বয়সের আগেই জোরপূর্বক যৌনসম্পর্ক করতে বাধ্য হন, আর ৩৫ শতাংশ নারীর প্রথম এ অভিজ্ঞতা হয় ১৯ বছর বয়সে পা দেওয়ার আগেই। অর্থনৈতিক নির্যাতনও গ্রামে একটু বেশি দেখা যায়। এমনকি ভোট দেওয়ার মত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তেও তারা বাধ্য হন অন্যের মতামতে কাজ করতে।
নারী নির্যাতনের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত যে রূপগুলো বর্তমানে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে তাদের বর্ণনা নিম্নরূপঃ
ধর্ষণঃ নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে (২০০০) বলা আছে, নিজের স্ত্রী বাদে ১৬ বছরের বেশি বয়সী মেয়ের সম্মতি ছাড়া অথবা তাকে ভয় দেখিয়ে বা প্রতারণামূলকভাবে রাজি করিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গম মানেই ধর্ষণ। তবে নিজ স্ত্রীর বিষয়টি ভিন্ন। তার বয়স ১৩-এর কম না হলে দণ্ডবিধিতে ধর্ষণ বিবেচনায় আনার সুযোগ নেই। ১৬ বছরের কম বয়সী কোন মেয়ের সাথে সম্মতিতে বা অসম্মতিতে যৌন মিলনকেও ধর্ষণ বলা হয়। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না যে, অনেক পুরুষও ধর্ষণের শিকার হন। যেমনঃ যৌনানন্দ লাভ বা বিকৃত যৌনাচারের কারণে বয়েসী কোনো নারী দ্বারা নাবালক বা বয়েসে ছোট কারো ধর্ষিত হওয়া কিংবা জেল, মক্তব বা অন্যত্র অন্য পুরুষ দ্বারা ধর্ষিত হওয়া। তবে যেহেতু অধিকাংশ ধর্ষণ পুরুষরাই করে তাই ধর্ষণ বলতে নারী ধর্ষণকেই নির্দেশ করা হয়। ডা. এমএ হাসান পরিচালিত ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির তথ্য অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধকালীন ১ লাখ ৬২ হাজার নারী ধর্ষণসহ নির্যাতনের শিকার এবং আরও ১ লাখ ৩১ হাজার হিন্দু নারী স্রেফ গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন। উন্নত দেশে ডেট রেপ বা অভিসার ধর্ষণ হলো ধর্ষণের প্রধান কারণ। তবে ভয়ের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশেও ডেট রেপ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে।
যৌতুক প্রথাঃ নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ অনুযায়ী “যৌতুক” বলতে বোঝায় কোন বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সহিত জড়িত বর পক্ষের অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে, বিবাহের পণ হিসাবে বিবাহের কনে পক্ষের নিকট দাবীকৃত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ; অথবা কোন বিবাহের কনে পক্ষ কর্তৃক বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সহিত জড়িত কনে পক্ষের অন্য কোন ব্যক্তি কতৃক উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে, বিবাহের পণ হিসাবে বিবাহের বর পক্ষের নিকট দাবীকৃত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ। ২০১৭ সালে সংঘটিত নির্যাতনের ৩২% যৌতুকজনিত কারণে ঘটেছে (সমকাল, ৬-০৩-’১৮)।
পাচারঃ জাতিসংঘের মতে ‘শোষণের উদ্দেশ্যে হুমকি বা শক্তি প্রয়োগ অথবা অন্যান্য ধরনের বাধ্যকরণ, অপহরণ, প্রতারণা, বিশ্বাসহরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার অথবা হুমকিপূর্ণ স্থান অথবা একজন ব্যক্তির উপর অপর ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ আরোপের উদ্দেশ্যে অর্থের লেনদেন বা সুবিধা আদায়করণ’।
মৌখিক নির্যাতনঃ যৌন নিগ্রহমূলক তীব্র বাক্যবাণের দ্বারা এ অপরাধ সংঘটিত হয়।
তারুণ্যঃ তরুণ বলতে একতরফাভাবে শুধু বয়সে কচি ছেলেকেই বুঝায় না। এটি একটি সর্বজনীন অভিধা যা নারী, পুরুষ এমনকি বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য হতে পারে। তারুণ্য হলো মানসিক ও শারীরিক উভয় অবস্থার সর্বোচ্চ উন্নতির সমন্বিত শিখরবিন্দু। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় তার বাহ্যিক বা শারীরিক তারুণ্যের কমতি নেই কিন্তু তার অভ্যন্তরীন জগৎ তারুণ্যের ছিঁটেফোঁটাহীন। আবার অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তার মনে চিরবসন্তের তারুণ্য কিন্তু শরীরের জ্যামিতিক বলিরেখা বলছে তার বয়স বেড়েছে। মানুষের মনোজাগতিক শক্তিই মানুষকে অমিত তেজশক্তিতে বলীয়ান করে।
বর্তমান অবস্থাঃ গণমাধ্যমে মাদক, বাল্যবিয়ে কিংবা নারী নির্যাতনের যে চিত্র প্রকাশিত হয় তা নিশ্চিতভাবেই এ ধরনের ঘটনার ভগ্নাংশমাত্র। আবার, সব দেশেই এ বিষয়গুলো কম উত্থাপিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের হলিউডের অভিনেত্রীদের সাথে ঘটে যাওয়া যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদস্বরূপ ফেসবুকে মি টু হ্যাশট্যাগের ছড়াছড়ির কথা।
বাংলাদেশ একটি যৌন রক্ষণশীল দেশ। এছাড়াও এ দেশে যৌন শিক্ষা বা যৌনতা সম্পর্কিত গণধারণা অবৈজ্ঞানিক ও কল্পনাপ্রসূত। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ এখনও জানে না যে, স্ত্রীর সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনসম্পর্ক স্থাপন এবং অন্যান্য যৌন অপরাধ সংঘটনকে একত্রে বৈবাহিক যৌন নিগ্রহ বলা হয়। আমাদের দেশে বৈবাহিক জীবনে এক বা একাধিকবার বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯০ শতাংশের বেশি নারী। কিন্তু এরচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক কথা হলো যে, বৈবাহিক ধর্ষণ সম্পর্কে অধিকাংশ নারীর ধারণাই নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে দেখা গেছে, এ দেশের ৮০ শতাংশ নারী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার। এছাড়াও তাদের তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সালে বাংলাদেশে নির্যাতিত নারীর ৮৭ ভাগ স্বামী/ সঙ্গী দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলো। অনেকে বলেন অশালীন পোশাক পরা বা তথাকথিত শারীরিকভাবে সুন্দরী মেয়েরা বেশি ধর্ষণের শিকার হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায় যে, এ ধারণাগুলো সত্য নয়। এমনকি ধর্ষণের ক্ষেত্রে ৬৬% নারী দরিদ্র হলেও বৈবাহিক অবস্থা তেমন ধর্তব্যের বিষয় না। কেননা, বাস্তব জীবনে আমরা দেখি, ধর্ষিতা পূর্ণবয়স্ক নারীর সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি নারীশিশু (সমকাল) এবং অনেক ছোট-ছোট ছেলেরাও ধর্ষণের শিকার হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী গত সাড়ে পাঁচ বছরে দেশে ৫,২৪৮জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা জানিয়েছে গত ৬ মাসে ১৪১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শিশু অধিকার ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৬ মাসে ২৯৮ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কিশোরীদের রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে, প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের হেনস্তা করা হচ্ছে, মুঠোফোনে আপত্তিকর ছবি তুলে তা প্রচার করা হচ্ছে। বছর দু-এক আগে আইসিডিডিআর,বি পুরুষদের ওপর একটি জরিপ চালায়। তাতে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, আপনি কি নারীকে অধস্তন মনে করেন? ৯৭ শতাংশ পুরুষের উত্তর ছিল হ্যাঁ। নারীদের মাধ্যমে যদি বাংলাদেশকে বিশ্বে পরিচয় দিতে হয় তবে বলতে হবে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মাতৃ মৃত্যুহারের দেশ। এখানে বয়স্ক নারী সাক্ষরতার হার পুরুষের তুলনায় কম, নারীর গড় আয়ু পুরুষের তুলনায় কম, নারী নির্যাতন সহনীয় মাত্রার উর্ধ্বে। সিডও সনদের দুইটি ধারার ২ নং এবং ১৬-১(গ) সরকারের সংরক্ষণ এখনও বলবৎ। ২ নং ধারাটিকে বলা হয় সনদের প্রাণ। এ ধারায় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক রীতিনীতি, প্রথা, আচার-ব্যবহার, নিষিদ্ধ করা হয়েছে ও বৈষম্য বিলোপ করে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতার নীতিমালা গ্রহণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং ধারা ১৬-১(গ)তে আছে বৈবাহিক সর্ম্পক বিদ্যমান অবস্থা ও বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের একই অধিকার থাকবে। পবিত্র কুরআন সুন্নাহ ও শরীয়ত আইনের বিরোধী বলে আপত্তি জানিয়ে বাংলাদেশ সরকার এই দুইটি ধারা সংরক্ষণ প্রত্যাহারের স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছে না। অপরদিকে, যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০ মোতাবেক যৌতুক গ্রহণই নয়, যৌতুক প্রদান ও যৌতুক দাবি করাও শাস্তিমূলক অপরাধ। এ আইন অনুযায়ী যৌতুক দাবি করা কিংবা আদান-প্রদানের এক বছরের মধ্যে ফৌজদারী আদালতে মামলা করতে হবে। এজন্য দায়ী ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ৫ বছর সর্বনিম্ন একবছর কারাদণ্ড বা জরিমানা কিংবা উভয় শাস্তি প্রদান করা যাবে। এ আইনের অনেক ধারা-উপধারা রয়েছে যা আমরা অনেকেই জানি না। অথচ এটি জানা অত্যন্ত প্রয়োজন।
পুরো বাংলাদেশের এ ভয়াবহ চিত্রের একটি খণ্ডচিত্র আমাদের ধনবাড়ী উপজেলা, বিশেষত পৌরসভা। ইদানীং এলাকায় ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের অবাধ প্রাপ্যতা আমাদেরকে স্তম্ভিত করে। এছাড়াও চুপি-চুপি বাল্যবিয়ে এবং নারী নির্যাতন প্রকাশ না হলেও আশে-পাশের অনেকেই এর ভুক্তভোগী। এর কারণ পর্যালোচনা করলে বলা যায় যে, সামাজিক অবক্ষয় এর মূল কারণ। সামাজিক অবক্ষয় থেকে জন্ম নিচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। জনবিচ্ছিন্নতা বা ভার্চুয়াল জগতে মাত্রাতিরিক্ত সময় অপচয় যুবসমাজের মধ্যে তৈরি করছে হতাশা। যার ফলে কর্মহীনতা ও অন্যান্য হতাশা কাটানোর আপাত সমাধান হিসেবে বাড়ছে মাদকাসক্তি। অনেক ক্ষেত্রে মাদকাসক্তরাই হয়ে উঠছে বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতনের (২%) মূল কারণ।
উত্তরণের পথে তরুণদের সংযুক্ততাঃ আশার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ এখন কর্মক্ষম তরুণ। এই অসম্ভবকে সম্ভব করা তারুণ্যকে মাদক, বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতনের অসমসাহসিক যোদ্ধা হিসেবে ব্যবহার করা এখন সময়ের দাবী। তারুণ্যের রয়েছে অবাধ অপ্রতিরোধ্য সর্বভুক গতি। যে গতির কারণে উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু সর্বত্র সে সমভাবে পূজনীয়। কিন্তু এই গতিই তার দুর্বলতা, যা তাকে ধ্বংস করতে যথেষ্ট। গতিকে যদি সঠিক পথে পরিচালিত করা যায়, তবে তা চলার পথে সোনা ফলায়, কিন্তু গতি কুপথে গেলে তা অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষতি সাধন করে। বর্তমান প্রজন্মের তারুণ্য বিভ্রান্তি, বিশ্বাস ব্যবসায়, প্রলোভন, অনৈতিকতা, মেকি সুখের মায়া, অহংবোধ, হুজুগ, মাদক, যৌন বিকৃতি, সম্পর্কের ফাটল, অতিযান্ত্রিকতা, সকাল-সন্ধ্যা প্রেম, হতাশা, আত্মহত্যা প্রভৃতি নানা রকম ধোঁয়াশায় আবৃত। তাদের পৃথিবীকে পরিবর্তন করার মত শক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে ডাঙায় তোলা মাছের মত খাবি খাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একটাই পথ। তা হল যুগপৎভাবে স্বশিক্ষা ও সুশিক্ষা। একমাত্র মানবিক, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী শিক্ষাই পারে প্রবল তারুণ্যের বারুদশালায় দেয়াশলাই কাঠির মত কাজ করতে। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহায়ক হিসেবে প্রয়োজন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া কিংবা বৌদ্ধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। কেননা, সংগঠিত শক্তি যেকোন বৃহৎ অপরাধকে সহজেই পরাজিত করতে পারে। তরুণদের মনে রাখতে হবে, বর্তমানে আমরা কোনো রূপকথার রাজ্যে বসবাস করি না যে, রাজপুত্র এসে তার কারিশমা দিয়ে পরিস্থিতি অনুকূল করবেন। বরং একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে আমরাই আজ একেকজন রাজপুত্র, সুপারম্যান, ব্যাটম্যান বা স্পাইডারম্যানের মত সুপার হিরো। পুরো পৃথিবীটাই আজ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এক্ষেত্রে অনেক দুরাশার মাঝে একটি আশার আলো আমিসহ প্রায় সব অধূমপায়ী সদস্যদের সংগঠন অভয়ারণ্য (Sanctuary)। মাদক নিরাময়ে এ সংগঠনের বেশ কিছু অপ্রকাশিত ব্যক্তিপর্যায়ের কাউন্সেলিং ও গাইডেন্স পরিচালিত হয়ে আসছে। আবার, গত ৪ সেপ্টেম্বর (২০১৭) রাতে সংগঠনটির এক সদস্যের তৎপরতায় পূর্ববর্তী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব শামীম আরা রিনির হস্তক্ষেপে বন্ধ হয় একটি বাল্যবিয়ে। এছাড়াও গত ২৪ এপ্রিল (২০১৮) বিকেলে সংগঠনের সদস্যদের মাধ্যমে বন্ধ হয় একটি পাচার ও শিশুধর্ষণ।
সুপারিশ/ প্রস্তাবনাঃ

প্রতিরোধমূলকঃ
১। অবকাঠামো উন্নয়নের মত এক্ষেত্রেও পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ভিত্তিতে একটি নাগরিক সেল গঠন করতে হবে। সংগঠন ও প্রশাসনের সম্মিলিত উদ্যোগে এটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন সেলের মত কাজ করবে।
২। সাংস্কৃতিক, সামাজিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধূলায় তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি স্থাপন ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যাবলি বৃদ্ধি করতে হবে।
৩। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধে নিজস্ব সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে কেন্দ্রীয়ভাবে কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
৪। মূল্যবোধের জাগরণের জন্য যৌনশিক্ষা প্রবর্তন ও নৈতিক শিক্ষা জোরদার করতে হবে। লিঙ্গ বা অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সব মানুষ সমান, এ চিন্তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। যেকোন অপরাধীর ‘ভিলেন ইমেজ’ তৈরি করতে হবে। অপরাধী যতই আপনজন হোক না কেন, তাকে ‘সোশ্যাল আউটকাস্ট’-এর দৃষ্টিতে দেখার গণদৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে।
৫। ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন ১৮৭২, বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ (সংশোধিত ’৮৪), মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১, বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) আইন ১৯৭৪, যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০ (সংশোধিত ’৮৬), পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ (সংশোধিত ২০০৪), নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০, আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০, এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১২), ভ্রাম্যমান আদালত আইন ২০০৯, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ ইত্যাদির যুগোপযোগী নবায়ন ও কার্যকর বাস্তবায়ন করতে হবে।
৬। বেকারত্ব নিরসনে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তরুণদেরকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত করতে হবে।

প্রতিকারমূলকঃ
১। ইতিবাচকভাবে আসক্তদেরকে পূর্বের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য সহযোগিতা করতে হবে।
২। অভিযুক্তদের রাজনৈতিক আশ্রয় বা অন্য কোন প্রকার প্রশ্রয় না দিয়ে অবশ্যই বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সালিশের মাধ্যমে নামমাত্র জরিমানায় মীমাংসা অথবা অভিযুক্তদের সাথে বিয়ে দেওয়ার মত হাস্যকর সমাধান বাদ দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক উন্মুক্ত বিচার করতে হবে। এতে ভবিষ্যতে অন্যরা অপরাধ করতে নিরুৎসাহিত হবে। বিচার বহির্ভূত হত্যা বন্ধ করতে হবে। কেননা, হত্যা কোন সমাধান নয়, বরং এটি মানবাধিকার হরণ।
৩। ভুক্তভোগীকে অপরাধবোধ কিংবা গ্লানি থেকে বের করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ অনুযায়ী সংবাদ মাধ্যমে নির্যাতিতা নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বাধা-নিষেধ মেনে চলতে হবে। অপরাধের শিকার হয়েছেন এরূপ নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তৎসম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোন সংবাদ পত্রে বা অন্য কোন সংবাদ মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করতে হবে যাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়।
৪। প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি আক্রান্ত নারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে সাধারণত তারা যে ৩টি কারণে ধর্ষণ রিপোর্ট করতে দ্বিধাবোধ করেনঃ ক. ব্যক্তিগত স্পর্শকাতরতা; খ. ধর্ষক বা তার পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে আরো হুমকি বা প্রাণ-নাশের আশংকা; গ. পুলিশ অথবা বিচার বিভাগের উদাসীনতা, যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেওয়া কিংবা নিজেরাই নাজেহাল হওয়ার আশঙ্কা (Wright, 1991)।। এক্ষেত্রে তাদের সুরক্ষার ব্যাপারটি পুলিশ প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে।
৫। অপরাধীর বিকৃত মানসিকতার ও ভুক্তভোগীর পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।


শামীম আল মাহমুদ (শিমুল)
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, অভয়ারণ্য (Sanctuary)
(গত ১২ জুন ধনবাড়ী উপজেলা অডিটোরিয়ামে 'মাদক, বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতন রোধে তারুণ্য' শীর্ষক সেমিনারের মূলপ্রবন্ধ হিসেবে পঠিত)