বৃহস্পতিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৮

নির্বাচন ও রাজনীতিঃ আমরা কেন ভোট দেবো?



এরিস্টটলের ভাষায় ‘মানুষ রাজনৈতিক জীব।‘ তাই আমরা চাই বা না চাই আমরা জন্মগতভাবেই ভাল-মন্দ উভয় রাজনীতির শিকার। আর ভোটাধিকার হচ্ছে একজন নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার। তাই, রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে ব্যক্তির অভিব্যক্তি, মতামত, প্রতিবাদ, দ্রোহ, ক্ষোভ, ভালোবাসা, ত্যাগ, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ আশা-প্রত্যাশার বহির্প্রকাশের প্রতিচ্ছবি হচ্ছে ভোট। সমাজে ব্যক্তির একটা অবস্থানও নির্ণীত হয় ভোটাভুটি কিংবা নানা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। ‘না ভোট’টাও কিন্তু প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে এক নীরব প্রতিবাদ, যদিও ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নাগরিকের সেই অধিকারটাকেও খর্ব করা হয়েছে। আজ যারা নিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে ব্যস্ততা, নানা সমস্যা, অসচেতনতাবশত কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় না কিংবা নিতে পারে না তারা এক অর্থে বঞ্চিত। কিংবা ভিন্ন থিওরি মাথায় আপলোড করে চলমান বিচ্ছিন্নতা বা বৈরী প্রতিবেশ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন না। এক্ষেত্রে প্রবীর ঘোষের সেই লাইনটা প্রণিধানযোগ্য ‘কোন অসুস্থ্ সমাজ ব্যবস্থায় সুস্থ্ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য।‘ বিদ্যমান সিস্টেম বদলানো কিংবা উন্নতি-অবনতির প্রাসঙ্গিকতায় যাদের নিষ্ক্রিয় অবস্থান, এই শ্রেণির মানুষগুলোর অপর নাম ‘নিরীহ’, ‘নিরপেক্ষ', 'রাজনীতি উদাসীন', 'সাঃ আমজনতা'যাদের মুখ থেকেই বেশি শোনা যায় ‘রাজনীতির মধ্যে যাইয়ো না,' 'কী অইবো ভোট দিয়া', 'অত গ্যাঞ্জামের মধ্যে যাইয়ো না', 'প্রতিবাদ কইরা লাভ নাই', 'নিজে ভালা থাকলেই জগৎ ভালা', 'ওইখানে আমার তো কোন লাভ নাই আমি যামু ক্যা', 'যা মুনে অয় তাই হউকগা, তাতে তোমার কী' ইত্যাদি মানুষকে আলটিমেটলি নিরুৎসাহিত-স্তব্দ-নিষ্ক্রিয় করার ঔচিত্যমূলক অমৃত বচন! সমাজে এই মানুষগুলোই সবচেয়ে অসহায়, শোষিত-বঞ্চিত-লাঞ্চিত হয়ে আসছে অতীতে-বর্তমানে এমনকি ভবিষ্যতেও হবে। কেননা, আমাদের সমগ্র জীবন তথা ভোর থেকে রাত, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত ব্যবহার্য জিনিসপত্র, মৌলিক বিষয়াবলি, বাজারের পণ্য, চাল-ডাল-তেল-নুন-গ্যাস-বিদ্যুৎ, এসবের প্রকৃত বা ন্যায্য মূল্যের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, এলাকাস্থ মানুষ-আত্মীয়-বন্ধু-উপরতলা-নিচতলার মানুষের সাথে অপর মানুষের সম্পর্কগুলোও ক্ষমতাতান্ত্রিক রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত। কেননা, এসব কিছুই রাজনীতি তথা ব্যবসায়ীদের দ্বারা নির্ণীত ও নিয়ন্ত্রিত। মানুষ ক্ষমতার পূজারী, তাই ক্ষমতাতন্ত্রের আশেপাশে থেকে রাজনৈতিক সুবিধাদি ভোগ করে ঐ 'নিরীহ' শ্রেণির 'সাধারণ জনতা'কে হারিয়ে-ঠকিয়ে-ভয় দেখিয়ে-লোভ দেখিয়ে-চাপ প্রয়োগ করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কোন পক্ষে যাবো- ডোমিনেট করবো নাকি ডোমিনেটেড হবো? সবহারাদের দলে নাকি সর্বহারাদের উদ্ধার করে বিদ্যমান অচলায়তনে পরিবর্তনকামী-কর্মীদের দলে? সচেতনদের দলে নাকি অচেতনদের দলে? সেই সাথে বর্তমান সময়ে আরও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন-পাকপন্থী রাজাকারদের পক্ষে নাকি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে? চেতনাধারীদের পক্ষে নাকি চেতনাহীনদের পক্ষে নাকি চেতনা ব্যবসায়ীদের পক্ষে? সিদ্ধান্তটা আপনার। একেকটা নির্বাচন মানে রাষ্ট্রের ক্রান্তিকালীন সময়। এসময় আপনাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে সচেতনচিত্তে। বিন্দুমাত্র অবচেতন আর চৈতন্যহীনতার সুযোগে দেখবেন একদিন পরিবার-সমাজে-এলাকায়-রাষ্ট্রে আপনার চিহ্নমাত্র নেই। আপনার নিজ জীবন, গৃহ, পরিবার-পরিজন, ভাই-বোন-সন্তান, আপনার ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার, চাকরি-ব্যবসা, প্রতিষ্ঠান এমনকি অপরজনার সাথে সম্পর্কও নিরাপত্তাহীনতার চাদরে ঢাকা পড়বে; যেথায় একটু ঝড়ো বাতাসে (কারও থ্রেটে) উড়ে যাবে, হালকা বৃষ্টিতে (ফাঁপর) ভিজে চুপসে যাবে। দেখবেন, আপনি বেঁচে আছেন অথচ সমাজ ও জাতীয় নিবন্ধন তালিকা হতে আপনার নামটিও উধাও হয়ে গেছে। ভোট দিতে এসে দেখবেন আপনার ভোট অন্য কেউ দিয়ে গেছে অথচ আপনার বলার-প্রতিবাদের ভাষা নেই, কারণ আপনি মেরুদণ্ডহীন 'নিরীহ-অসচেতন' মানুষ নামের মস্তিষ্কহীন জীব। অমুক বলে কেউ একজন আছে/ ছিল এটা মানুষ ভুলে যাবে, আর আপনি হয়ে যাবেন এই একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবী নামক গ্রহের বাংলাদেশের হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির প্রাণী। সুতরাং, ব্যক্তি তথা নিজ প্রয়োজনেই প্রত্যেকেরই রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। আর সেটার প্রতিফলন হোক একটা সুষ্ঠু-স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভোট দানের মাধ্যমে। স্বাধীনতার ৪৮তম বিজয় দিবসে একটি সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়তে রাষ্ট্রীয় বাইবেল সংবিধান বর্ণিত ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’, ‘সমাজতন্ত্র ও শোষণ হইতে মুক্তি’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা’ এই চার মূলনীতি যিনি লালন-পালন ও ধারণ করেন এমন ব্যক্তিকেই ভোট দিন। রাষ্ট্রের মালিক যেহেতু জনগণ সেহেতু নির্বাচনে জনগণের দ্বারা জনগণের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হোক একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটাই একজন ভোটারের প্রত্যাশা।



* (অভয়ারণ্য (Sanctuary) কর্তৃক প্রকাশিত বিজয়োৎসব সংখ্যা 'পুনর্জন্ম'তে প্রকাশিত) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন