আষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে নতুন একশিক্ষাচিন্তার ভিত্তিতে জার্মানির
বাভারিয়া ও স্ট্রাসবর্গে দুটি বিদ্যায়তনপ্রতিষ্ঠিত হয়। এ শিক্ষাচিন্তার
রূপকার ছিলেন Friedrich Fröbel(1782-1852) নামক একজন জার্মান শিক্ষাবিদ। আর
এই যুগান্তকারীশিক্ষাচিন্তাটি হল ‘কিন্ডার গার্টেন’ বা কে জি। জার্মান
ভাষায় Kinder শব্দটির অর্থ শিশু আর Garten অর্থ বাগান মানেকিন্ডার গার্টেন
অর্থ শিশুদের বাগান বা শিশু কানন। যেহেতু বর্তমানে পৃথিবীটা একটি‘বৈশ্বিক
গ্রাম’ তাই জার্মানি থেকে শুরু হওয়া তত্ত্বের প্রয়োগে এশিয়ার একটি
দরিদ্রদেশ বাংলাদেশের টাংগাইল জেলার ধনবাড়ী উপজেলায়ও (তখন উপজেলা ছিল না)
একটি বিদ্যালয়প্রতিষ্ঠিত হয় যার নাম ‘শিশু কানন’। আর এই কানন তথা স্কুলে
চারা হিসেবে আমারঅঙ্কুরোদগম হয় ২০০০ সালে ৩য় শ্রেণীতে ভর্তি হওয়ার মাধ্যমে।
জার্মানির প্রক্রিয়াপাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে
প্রবাসী হয়েছিল বলেই হয়তোঅপরাধের শাস্তিস্বরূপ এই প্রক্রিয়ার শিক্ষার্থীদের
প্রায়শ্চিত্ত করতে সরকারিস্কুলে ভর্তি হয়ে পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে
হত। বলাই বাহুল্য আমিও সেই পাপখন্ডনের জন্য অগ্রজ কাকাতো বোন রিংকি আপার
পদাঙ্ক ধরে বরমপুর স্কুলে ভর্তি ছিলামআর ওখান থেকেই প্রাথমিক বৃত্তি
পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। স্কুলের নামটা যদি ভুল হয়তবে আমি দুঃখিত কারণ
কাগজে-কলমে আমি ওখানকার ছাত্র হলেও কোনদিন ওই স্কুল-আঙ্গিনানিজ চোখে
দেখিনি। যাহোক কলেজিয়েট প্রাইমারী স্কুলের ২য় শ্রেণী পাস করে যখন আমাররোল
নং ৪ থেকে অবনতি হয়ে হয়েছিল ১০ তখনই খাঁকি প্যান্ট ছেড়ে আমি এখানকার
মেরুনপ্যান্ট যখন পরা শুরু করলাম। হয়তো ডাক্তারি আবহের পরিবারের ছেলে
হিসেবে আমার এইহাওয়া বদল করতে হয়েছিল। তবে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে গিয়ে
নতুন বন্ধু হিসেবেপেলাম সুমন, শুভ আর নেপালকে আর পরে বান্ধবী হিসেবে
পেয়েছিলাম ফার্স্ট গার্ল মুক্তা,কণিকা, লিমা, ডলিও দোলাকে। নতুন শুরু হওয়া
স্কুল হিসেবে এখানকার ছাত্র সংখ্যা ছিল অনেক কম তাইচাহিদার সংখ্যারেখা
অনুসারে সুবিধা ছিল জন প্রতি অনেক বেশি। তাই বস্তুগত খেলারসাথী হিসেবে ছিল
একটা হ্যান্ডবল। যাকে আমি সৃজনশীলভাবে ফুটবলে রূপান্তরিত করে খালিমাঠে একা
একা খেলা করতাম। কে জানে আমার প্রতিযোগিতার প্রতি বিরূপ মনোভাব ও ‘একলাচলো
রে’ নীতির প্রতি শ্রদ্ধাবোধের একটা অবচেতন বহিঃপ্রকাশ হয়তো ছিল ওটা!
এখানেআমার ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দক্ষতা চরম পর্যায়ে ছিল তার একটা কারণ অবশ্য
অবশ্যইপ্রতিযোগীর স্বল্পতা!
এখানে পড়ার সময় আমি ৩য় শ্রেণীতে
জেলাপর্যায়ের বেসরকারি বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি এবং ব্যর্থ হই। পরের
বছরব্যর্থতাকে পরাজিত করে ৪র্থ শ্রেণীতে রাব্বানি স্মৃতি উপবৃত্তি লাভ করি।
আর ৫মশ্রেণীতে মেধাতালিকায় সরকারি বৃত্তি লাভ করি। এই যে সফলতা তা ৪র্থ
শ্রেণী পর্যন্তছিল আমার বাবার তত্ত্বাবধান ও শিক্ষকদের শ্রেণী পাঠের ফসল আর
৫ম শ্রেণীতে এর সাথেযোগ হয়েছিল ছাত্রসখা বৃত্তি গাইডের সহায়তা। যা বর্তমান
প্রজন্মের গাইড বই ওপ্রাইভেট-কোচিং নির্ভর ব্রয়লার মুরগীর মত সর্বোচ্চ
ফলাফলকারী ছাত্র-ছাত্রীদের কাছেরূপকথার গল্পের মত মনে হলেও কিছু করার নেই।
এখানে
যাদেরকে শিক্ষক হিসেবে পেয়ে আমি ভাগ্যবান তারা হলেন গফুরস্যার, কুদ্দুস
স্যার,সুশীল স্যার, লিটন স্যার, আমার প্রিয় মনোরঞ্জন স্যার, সুমনা ম্যাম,
বিউটি ম্যাম প্রমুখ।
সহ-শিক্ষাক্রমিক যে কাজগুলো করতাম তারএকটি হল
টিফিন পিরিয়ডে গাছের মরা ডালকে বন্দুক বানিয়ে মাঠে ক্রলিং করে
মুক্তিযোদ্ধাহয়ে শত্রু শত্রু খেলা। পরে শুনেছি আমার এ কাজ নাকি সাকিনা
মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের তৎকালীন প্রধান শিক্ষিকাকে চমৎকৃত করেছিল।
এখানেই আমি পি টি ক্লাসেলাইনের শেষে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় জনৈক
শিক্ষকের কাছ থেকে আমার গানেরগলার প্রশংসা পাই। ফলে ৫ম শ্রেণীতে আবেগের
আতিশয্যে জীবনে প্রথম মুখস্থ করাতৎকালীন জনপ্রিয় সিনেমা ‘হঠাৎ বৃষ্টি’-তে
নচিকেতার গাওয়া ‘সোনালী প্রান্তরে...’গানটি বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে
গাওয়ার প্রস্তুতি নেই। কিন্তু শিশু কাননযেহেতু একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের মত
ছিল তাই গার্লস স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে শেষপর্যন্ত আমি সুযোগ পাইনি। এ
স্কুলে পড়ার সময় আমার একটি গুণ খুবই সমাদৃত হয়েছিল আরতা হল আমি ঘাস, লতা,
পাতা ও নারিকেল গাছের পাতার জালিকা অংশ দিয়ে ভালো পাখির বাসাবানাতে পারতাম
যা অবিকল আসল পাখির বাসার মতই হতো। কয়েকজনকে ওগুলো বানিয়ে উপহারওদিতাম।
শিশু
কানন আমার আত্মবিকাশ ঘটিয়েছিল।মুখচোরা আমিই সক্রেটিসের Know thyself এর
রাজপথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছিলাম এসময় থেকে। কলেজিয়েট স্কুল থেকে যে ছেলেটি
১০ম স্থানঅধিকার করে এখানে ভর্তি হয়েছিল সে ৫ম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষায়
প্রথম স্থান অধিকারকরে আবার পুরোনো ঠিকানার মাধ্যমিক ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ১ম
স্থান ছিনিয়ে নিয়েছিল।তার পরের ইতিহাস অবশ্য অন্য এক রাজ্যের গল্প।