জীবনের ২২টি বসন্ত পার করলেও এখনো
কেউ কথা রাখেনি। তাই কন্যা রাশির জাতক হয়েও এবং ৪র্থ
শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় ২০০১ সালে মাধ্যমিক স্তরে পড়ুয়া এক আপুর কাছ থেকে
প্রথম ভ্যালেন্টাইন'স কার্ড পাওয়া সত্বেও আমি এখনো সিঙ্গেল। ডাবল না হতে পারার একটা কারণ বোধ করি অতি দ্রুত হাঁটা
যা বেশিরভাগ মেয়েকে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য করে। কিন্তু শুধু না পারার সাম্যাবস্থা নয় আমার সাথে যাবতীয় ডাবল জিনিসের
শত্রুতা। তাই দ্বিচক্রযান বা ইঞ্জিনচালিত দ্বিচক্রযান কোনটাই ঠিক আমার সাথে
মানানসই নয়। কিন্তু ধনবাড়ী কলেজিয়েট স্কুল ছাত্র ফোরামের প্রথম স্যুভিনীর করার
কাজে আমাকে মোটর বাইকে বেশিরভাগ সময় সুমন ভাইয়ের পিছনে দ্বিতীয় আরোহী হয়ে ঘুরতে হয়েছে।
আমার স্পষ্ট মনে আছে যেদিন এনটিভি অফিস
থেকে ফোরামের প্রায় ৬০০ ফরম নিয়ে যাচ্ছিলাম প্রেসে সেদিন বেইলী রোডের সিনেম্যাটিক
অ্যাক্সিডেন্টের কথা। প্রাইভেট কারের সাথে সুমন ভাইয়ের মোটর বাইকের সংঘর্ষের পর
তেমন একটা আহত না হলেও পিছন থেকে উড়ে গিয়ে এক ডিগবাজি খেলাম। সুমন ভাইয়ের পা ছড়ে
গেল। আমার কনুইয়ের রক্তে ফরমগুলো হালকা রঙ্গিন হল। পরবর্তীতে সে অবস্থায়ই
ফরমগুলোকে প্রেসে নেওয়া হল। সেটিই ছিল আমার প্রথম আর সুমন ভাইয়ের দ্বিতীয় বাইক
অ্যাক্সিডেন্ট। আবার একদিন রাত সাড়ে বারোটায় প্রেস থেকে বেরিয়ে সোলায়মান ভাইয়ের
মোটর বাইকে চড়ে শাহবাগ পৌঁছেছি।
ঢাকা থেকে এলাকায় গিয়ে ব্যাচ প্রতিনিধির দায়িত্বে হাত দিলাম। আমার অবশ্য
বেশ সুবিধা ছিল কারণ আমার সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম সহপাঠী সর্বোচ্চ সক্রিয়
সুজনকে। অপু ভাইয়ের মোটর বাইকে প্রতিদিন সকালে তেল তুলে সুজনের পিছনের সিটে বসে
সহপাঠীদের বাড়ীতে গিয়ে তাদেরকে রেজিস্ট্রেশন করানো শুরু করলাম। এ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
বিশাল বিচিত্র। এ সময় আমার নিজেকে
আর্নেস্টো গুয়েভারা দে লা সেরনা মনে হচ্ছিল।
১৯৫২ সালে ডাক্তারি পড়ার শেষদিকে ২৩ বছরের এই ছেলেটি যেরকম ল্যাটিন আমেরিকার ৮,০০০
কিলোমিটার রাস্তা ৪ মাসে ঘুরেছিল তার বন্ধু ২৯ বছর বয়সী আলবার্তো গ্রানাদোর সাথে
‘পদেরসা’ নামক একটি নর্টন ৫০০ মোটর বাইকে ঠিক তেমনি আমিও সুজনের সাথে প্রতিদিন
প্রায় ৮০ কিলোমিটার ধনবাড়ীর এমাথা থেকে ওমাথায় ঘুরেছি চরকির মত। অনেক দিন
মধ্যাহ্নভোজ মিস হলেও বিশেষত বান্ধবীদের বাড়িতে গিয়ে যে স্ন্যাকস খেয়েছি তাতে খুব
একটা ক্ষতি হয়নি। যাহোক আর্নেস্টোর ওই ভ্রমণের সময় দেখা ল্যাটিন আমেরিকার কুৎসিত
দারিদ্র্যের বাস্তব চিত্রই তাকে পুরো পৃথিবীর কাছে বিপ্লবী চে হয়ে উঠতে সাহায্য
করেছিল আর আমার ভ্রমণ আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে করেছে প্রসারিত। উপজেলা সদরের
প্রাণকেন্দ্রে আধা কৃষিজীবী পরিবারে মানুষ হয়ে আমি জীবনকে যেভাবে দেখতে অভ্যস্ত
ছিলাম তার অবসান হয়েছিল এর ফলে। আমি এসময় ধনবাড়ীর প্রান্তিক অঞ্চলের প্রান্তিক
জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন দেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছি যা সদরে থাকার কারণে সব হাতের কাছে
পাওয়ায় সম্ভব হয়নি। এছাড়াও এলাকার
বিভিন্ন গলি ঘুপচি ও ভৌগলিক সীমারেখার কিছুটা
চেনা হয়েছে এর ফলে। আর যে সহপাঠীদের আমি স্কুলে একরকম দেখতাম পারিবারিক বলয়ে তাদের
এক সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র আমাকে স্তম্ভিত করেছে। শেষমেষ এই সিদ্ধান্তই আরো
পাকাপোক্ত হল যে আমরা সবাই অর্থনীতির পুতুল।
স্কুল জীবনের আমার এত এত স্মৃতি
থেকে বাছাই করা কয়েকটির যে সারমর্ম জমা দিয়েছিলাম তা সমকালীন আধুনিকায়নের মত
সংক্ষিপ্ত করতে বলা হয়েছিল। যদিও লেখাটি শেষপর্যন্ত বিনা কর্তনেই ছাড়পত্র পেয়েছিল।
তবু আরেকবার যদি সারাংশ দাঁড় করাই তবে সহপাঠী আকাশের
সাথে হাতাহাতির পর তাকে ঢিলে পরাস্ত পালানোর মাধ্যমে যে স্কুল জীবনের শুরু তা
পুনর্জন্মের পর ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে প্রথমবার কুরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতায় স্কুলমঞ্চে
কম্পিত হাঁটুতে উঠায় গিয়ে ঠেকে। এরপর প্রথমবারের মত
কুসুম কুসুম ভালবাসার অনুভূতির সূত্রপাতের স্মৃতি, ৮ম শ্রেণীর শেষদিকে অনানুষ্ঠানিকভাবে
ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়া (তবে পৃথিবী কোন অনাগত পেস নক্ষত্রকে হারিয়েছিল কিনা বলতে
পারব না!), ৮ম শ্রেণী থেকে শ্রেণীভিত্তিক দেয়ালিকার প্রতিটিতে লেখক থাকলেও কোনটিতে
সম্পাদক না হতে পারার অপূর্ণতা, ১০ম শ্রেণীর ১ম সাময়িক পরীক্ষায় অর্থাৎ প্রাথমিক
স্তরের ন্যায় মাধ্যমিক স্তরের মোট নাম্বারের ভিত্তিতে ক্রম নির্ণায়ক শেষ পরীক্ষায়
গণিতে সর্বোচ্চ নাম্বার ৭৬ পাওয়ার সুবাদে প্রথম হওয়া (পার্থক্য সৃষ্টিকারী গণিতের
দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নাম্বার ৫৯ পেয়েছিল শাহীন) ইত্যাদি সময়ানুগ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে
শেষ হয়।
আমি
বন্দুকধারী মানুষদের বরাবরই ঘৃণা করি। আর এদের মধ্যে বেশি ঘৃণিত পুলিশদের জাতীয়
পোশাক খাঁকি। কিন্তু দিন মাস বছরের হিসাবে অনেক আগে এ স্কুল ছাড়লেও প্রবলভাবে এখনও
মিস করি এখানকার খাঁকি-সাদাকে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন