আমার মত বাজে চেহারার ও শীর্ণকায় ছেলেকেও
যে কেউ ভালবাসতে পারে তা আমার মা-বাবাকে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। তার অবশ্য
একটা কারণ আছে। আমার আগে আমার মাকে দুইজন মৃত সন্তানের মুখ দেখতে হয়। আমি ছিলাম ৭
মাসের প্রিম্যাচিউরড ছেলে সন্তান। ভূমিষ্ঠ হবার পরও আমার ফুসফুসের কার্যকারিতা
শুরু হয়নি। অর্থাৎ সবার মতে জন্মানোর সাথে সাথেই আমি কান্নাকাটি করিনি। সবাই
ভেবেছিল আমিও আগের দুই ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছি। কিন্তু আমার দাদীর চড়-থাপ্পড়
আমাকে কাঁদতে বাধ্য করে। সেই কান্নাই সবার মুখে হাসি ফুটিয়েছিল।
আমরা ৩ ভাই-বোন। বড় বোন শাহনাজ পারভীন (২০
জানুয়ারী ১৯৮৫-?)-এর সাথে রক্তের কোন সম্বন্ধ না থাকলেও তার সাথে সম্পর্কটা আরো
বেশি। আমার খালুর মৃত্যুর পর বাবা তার কন্যা প্রীতি থেকে খালার ৩য় ও ছোট মেয়েকে
দেখাশোনার ভার নেন। তারপরই আমি। আমি রূপে কখনোই আকর্ষণীয় না তার মধ্য আবার আমার
জিভ বিদ্যুতের মত তাই দাদা ও নানা উভয় দিকের আত্মীয়রা বলেন আমি নাকি অপর বংশের গুণ
নিয়ে জন্মেছি। আমার ছোট ভাই সাব্বির আল মাহমুদ (৫ জুন ১৯৯৬-?)। ওর কথা মনে হলেই
আমার আলেক্সান্ডার দ্যুমার ‘দ্য কর্সিকান ব্রাদার্স’-এর কথা মনে হয়। তার সাথে আমার
মিল খুবই কম। তাই সবাই তাকে নিজেদের গুণাবলি সম্বলিত বলে। আমাদের বাবা-মার বিবাহ
বার্ষিকী ৬ জানুয়ারী ১৯৮৭। আমার বাবার নাম মোঃ দেলোয়ার হোসেন (১ নভেম্বর ১৯৫৮-?)।
এক কথায় কাদা মাটির মানুষ। আমার দাদার নাম বাজেতুল্লাহ মুন্সী দাদী সখিনা বিবি।
শিক্ষানুরাগী দাদা আমাকে খুব পছন্দ করতেন কারণ আমি নাকি তার মত চেহারার ছিলাম।
কিন্তু আমি যখন খুব ছোট তখনই তিনি মারা যান। ফলে বড় হয়ে আমি যে তাকে উচ্চতার দিক
থেকে পরাজিত করছিলাম তা তার দেখা হয়নি। আমার বাবার দাদা শহর আকন্দ দাদী আয়াল বিবি।
বাবার নানা হাজী তারিফুল্লাহ নানী খোশজান বিবি। আমার মায়ের নাম সুরাইয়া পারভীন (১৬
ফেব্রুয়ারী ১৯৭২-?)। আমার নানার নাম হাজী তপসের আলী নানী মমিরন বেগম। মার দাদা
নছর দেওয়ানী দাদী বুলি। মার নানা আজিতুল্লাহ সরকার নানী আয়মনা। আমার জ্ঞেয়
পূর্বসূরির তালিকা এ পর্যন্তই। আর আমাদের পরিবারে উত্তরসূরিও আছে একজন, সে হল আমার
বোনের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদাউস (১১ নভেম্বর ২০০২-?)।
আমার পরিবার আমার কাছে মন্দিরের মত। এখান
থেকেই আমার প্রাক-প্রাথমিক তথা জীবনের সবচেয়ে কার্যকর শিক্ষাগুলো পেয়েছি। আমার
চরিত্রের যা কিছু ভালো তার গোপন কুঠুরী আমার পরিবার। সুকুমারবৃত্তি ও বোধশক্তির
অংশটা বাবার কাছ থেকে পাওয়া আর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারটার জন্য আমি মায়ের কাছে
ঋণী। এছাড়াও সময়ের চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার বড় বোনের অবদান অস্বীকার করলে
আমি পাপী হব। ছোটবেলা থেকেই বাবার চাকরি ও কৃষিক্ষেত্রে অমানুষিক পরিশ্রম ও
আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি ভালবাসা আমাকে অবাক করত। আমি দেখতাম তার কথাকে মূল্যায়ন করা
হতো অন্য মাত্রায়। এমনকি বাজারে একবার ধান বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়ার সময় এক পাইকার
বাবার মুখে ধানের ওজন শুনে না মেপেই ধান কিনে নিয়েছিল। আমি তখন বলেছিলাম, ‘এরপর কম
করে নিয়ে আসবে’। বাবা বলেছিলেন যে কথা ও কাজে অসামঞ্জস্য রাখতে হয় না। তারপর থেকেই
আমিও তা কমবেশি মেনে চলি। আমার বাবা খুব ধার্মিক ও শিক্ষানুরাগী। আমার ৫ম শ্রেণি
পর্যন্ত আমার আনুষ্ঠানিক গৃহশিক্ষকও আমার বাবা। মনে আছে একটা সময় ‘গ্রন্থ বিপণী’
নামক লাইব্রেরীর সাথে চুক্তি ছিল যে আমি মাসে যা বই নেব বাবা মাস শেষে তা পরিশোধ
করবেন। তবে অন্য কিছু না শুধু বই। আমার ৫ম শ্রেণিতে একটা ফুটবল কেনার শখ ছিল।
কিন্তু বৃত্তির টাকা হাতে পেয়ে বই ছাড়া অন্য কিছু কেনা হয়নি। আর ফুটবল খেলাও
অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছিল। পরবর্তীতেও যেকোন সাফল্যে আমি বই উপহার নিতাম।
আমি একেবারে ছোট বেলায় খুব মোটা আর রোগা
ছিলাম। ফলে অবধারিতভাবেই আমাকে নিয়ে বাবা-মার বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে।
আমি সকালে উঠতে পারি না বলে বাবা-মা দুজনেই জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকে
আমাকে ডেকে দিতেন, এখনও দেন। তারা আমার বন্ধুত্বের সীমানা অর্থনীতি কিংবা লিঙ্গ
দিয়ে বেধে দেননি। তারা আমাকে নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তারা আমাকে শিক্ষা
দিয়েছেন স্থান, কাল, পাত্র নির্বিশেষে মানুষকে ভালবাসতে। তবে আমি বুঝে না বুঝে
তাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। ৫ম শ্রেণিতে আমার মারা যাওয়ার মত প্রচন্ড জলবসন্ত
হয়েছিল। সময়টা ছিল বৈশাখ আর আমাদের বাসারও সংস্কার কাজ চলছিল। তখন এক ঝড়ের রাতে
চলৎশক্তিহীন আমাকে নিয়ে চলছিল টানাটানি। বাবা এসময় সারারাত একটা খোলা টিনের চাল
ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন যেন তা উড়ে না যায়। আমার উপর তাদের প্রচুর প্রত্যাশা ছিল।
কিন্তু প্রতিউত্তরে আমি তাদেরকে নিরাশ করেছি। প্রথমে ক্যাডেট হতে না পেরে
পরবর্তীতে ডাক্তার হতে না পেরে। আমার বাবার খুব ইচ্ছা ছিল আমি মেডিক্যালে পড়ি।
কিন্তু বলা চলে আমি ইচ্ছাকৃতভাবে সেদিকে পথ মাড়াইনি। আফসোস যদি সময়টা আবার ফিরে
পাওয়া যেত!
আমার মা শিক্ষিতা ও উদ্যোগী। যদিও ভারতীয়
উপমহাদেশে নারীর শ্রম অর্থহীন। তবু তিনি হাঁস-মুরগী পালন করতেন ও তাদের বাচ্চা ও
ডিম বিক্রি করে সে টাকা পারিবারিক উন্নয়নে কাজে লাগাতেন। এছাড়াও এখনও তিনি সেলাই
মেশিন চালান। আমার স্বাস্থ্যের কল্যাণে প্রায় প্রতিটি জামাতেই মার করা সেলাইয়ের
আদর আছেই। আবার তিনি লাউ, কুমড়া ইত্যাদিও রোপণ ও পরিচর্যা করতেন। আমার বাগান করা ও
গাছ-গাছালির প্রতি যে ভালবাসা তার সূত্রপাত এখান থেকেই। মা এখনো আমার খাবারের
প্রতি উদাসীনতা কমানোর জন্য অনেক কষ্ট মিশ্রিত চেষ্টা করেন। আর বাড়িতে গেলে বলার
আগেই সব সময় আমার পছন্দের খাবার তালিকা, পিঠা, সবজি ইত্যাদি মায়ের যাদুকরী হাতের
পরিশ্রমে একে একে হাজির হয়। যদিও আমার আজ যা পছন্দ কাল তা পছন্দ নাও হতে পারে তাই
মার উপর খুবই অত্যাচার করা হয়। অনেক কিছু বুঝতে পারলেও আমি করতে পারি না। অপরদিকে
মাও আমাকে অতিরিক্ত অপত্য আদর করা থেকে বিরত হতেই পারেন না।
বড়
হওয়ার সাথে সাথে অনেক কিছু আর করতে পারি না। তার মাঝে আছে মধ্যবিত্ত পারিবারিক
স্ববিরোধী নীতি। তাই যতই বহির্মুখী হই না কেন কোন দিন বাবা-মাকে বলতে পারি না আমার
কাছে FAMILY
মানে Father And Mother I Love You। তাদের
জন্য কোন উপহার কিনেও তাদেরকে দিতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। তবে কিছু জিনিস আছে যা
না বললেও বুঝতে কষ্ট হয় না। আমার বিশ্বাস বাবা-মা এগুলো বোঝেন। কিন্তু আমার মন ভরে
না। আমি যদি কখনো একটি খারাপ কাজও করি তবু তাদের সাথে শেয়ার করি কিন্তু জীবনের এত
বড় একটা সত্য কেন যেন বলতেই পারি না। তাই মা দিবসে এই সত্যের লিখিত প্রকাশই আমার
বাবা-মার প্রতি আমার উপহার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন