শনিবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

ভালবাসা একটি অযৌক্তিক বিষয়


আমার কিছু ভক্ত ছোট ভাই আমাকে বলে আমি যেন ভালবাসা নিয়ে কিছু লিখি কিন্তু আমি লোকটা কেন যেন অ্যান্টি-রোমান্টিক তাই আর হয়ে ওঠে না নটর ডেম কলেজে পড়ার সময় কলেজের মাসিক ম্যাগাজিন ঢাক-ঢোল-এ ‘মুক্তির জন্য ভালবাসা’ নামে একটি বিশাল লেখা লিখেছিলাম যার বেশিরভাগই ছিল অন্যের মতামত; অবশ্য তার কোন কপি বর্তমানে আমার কাছে নেই তবে এবার ইচ্ছার বিরুদ্ধেই কলম ধরলাম
অমর্ত্য সেন বলেছেন একজন মানুষের অনেক পরিচিতি আমি ভালো বন্ধু, ভাল ভাই তবে ভাল প্রেমিকের তকমাটা আমাকে দেওয়া ঠিক হবে না তাই আমার ব্যক্তিগত চিন্তার প্রতিফলন এই লেখা যদি কেউ বিশ্বাস নাও করেন তবু আমি তাকে কিছু বলতে পারি না। কেউ যদি টিনএজ জীবনে মাত্রাতিরিক্ত আবেগে মেয়ে পছন্দ করার ইস্যুতে হাতাহাতি করেন, নিজের হাত কেটে অন্যের নাম লেখেন, কারণে অকারণে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন তাদের লেখাটি ভাল না লাগলেও আমার কিছু করার নেই। এছাড়াও যারা পার্শ্ববর্তী দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বলিউডের ছবি দেখে ভাবেন যে ভালবাসা যাদুকরী কোন এক প্রভাবক যার জন্য ধনী-গরিবের যে অর্থনৈতিক সীমারেখা তাকে ভেঙ্গে বাবা-মাকে উপেক্ষা করে উঠতি বয়সী দুজন ছেলে-মেয়ের হাত ধরে পালিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে তাৎক্ষণিকভাবে সুর-তাল-লয় ঠিক রেখে বিজয়সংগীত গাওয়া সম্ভব হয় তবে তারও আমি বিরুদ্ধচারণ করবো না। তবে আগেই জানিয়ে রাখি যে ‘প্রেম আর ভালবাসা এক নয়’ জাতীয় শাব্দিক গোলক ধাঁধাঁ নিয়ে আমার আগ্রহ নেই। তাই যদি আরো পড়তে চান তবে জেনে বুঝে নিজ দায়িত্বে পড়ুন।
ভালবাসার মধ্যে আমি ৬০% প্ল্যাটোনিক আর ৪০% প্যাফিয়ান মতের সংমিশ্রণে বিশ্বাসী এটা অপেক্ষাকৃত প্রাচীন মত হলেও আমি এটা পছন্দ করি অর্থাৎ আমি ফ্রয়েডের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রেমাদর্শকে এগিয়ে রাখি তবে একটা কথা স্পষ্ট যখন মানুষের সেকেন্ডারী সেক্সুয়াল হরমোন প্রবাহিত হয় তখন থেকেই সে শারীরিক ও মানসিকভাবে তার জৈবিক তাড়না অনুভব করে যেটি প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই পৃথিবীর অন্যতম একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তাই তো অ্যাডাম নন্দন কাননে সকল প্রকার স্বর্গসুখ পেয়েও ঈভের বিরহ অনুভব করেছিল। প্রচন্ড অবিশ্বাসীরাও তো স্বীকার করতে বাধ্য হবেন যে, মিথ পুরোপুরি মিথ্যে না, এটি প্রাচীন পূর্বপুরুষ থেকে আধুনিক উত্তরপুরুষদের বিবর্তিত অভিজ্ঞতার যোগফলের গড় জ্ঞানের ভিত্তিতে অজানা কৌতুহলকে কল্পনা দ্বারা নিবৃত্ত করার চেষ্টা। অর্থাৎ সে যুগের সর্বোচ্চ বিজ্ঞানের ব্যর্থতাকে আবেগ ও সাধারণ জ্ঞানের যৌথ সমন্বয়ে সিদ্ধ করার চেষ্টাও কিন্তু যাপিত জীবন বহির্ভূত কিছু না। তাই বলে আমি আবার বয়ঃসন্ধিকালীন সময়েই বিয়ে তথা বাল্য বিয়ের সমর্থন দিচ্ছি না শুধু বলছি যে নারী পুরুষের পারস্পারিক আকর্ষণ খুবই স্বাভাবিক বলে তাকে ট্যাবু বা পাপ হিসেবে চিহ্নিত করা ঠিক নয়। বরং এর উল্টো আকর্ষণ হলেই তা ভিন্ন চিন্তার বিষয়। ভালবাসার ক্ষেত্রে শরীর অবশ্যই একটি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান তা না হলে বিরহ কষ্টদায়ক হতো না। কিন্তু আমি মনে করি তার গুরুত্ব মানসিক সামঞ্জস্যের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম। এর পিছনের কারণ হিসেবে আমি বলতে পারি সমপ্রেমের কথা যেখানে সঙ্গমে নারী-পুরুষের জন্মগত দৈহিক সুসমন্বয় গৌণ হয়ে পড়ে। বিতর্কিত বিষয়গুলোর উর্দ্ধেও নারী পুরুষের বেশিরভাগ সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় মানসিক বৈপরীত্যের কারণে। যারা লিভ টুগেদার করেন তাদের ক্ষেত্রে এটি সহজেই গ্রহণযোগ্য হলেও বিবাহিত দম্পতির জন্য এটি একটি বিভীষিকাময় স্মৃতি হয় সামাজিক চুক্তির জন্য। আমার মনে হয় ভালবাসা না থাকলে সম্পর্ক জোর করে টিকিয়ে রাখার কোন মানে হয় না। নচিকেতার গানে আছে-
ভালবাসা আসলেতে একটা চুক্তি জেন অনুভূতি-টনুভূতি মিথ্যে
কেউ দেবে নিরাপত্তা, কেউ বিশ্বাস, আসলে সবাই চায় জিততে।
ভালবাসা আসলেতে পিটুইটারীর খেলা আমরা বোকারা বলি প্রেম,
ইটস এ গেম।
আসলে এটা একটা ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মতই। যেখানে জেতাটাই মূল কথা। তাই তো বলা হয় Everything is fair in love and war. তবে জেতাটা মাঝে মাঝে যোগ্যতার পাশাপাশি দৈবর উপরও নির্ভরশীল। তাই অনেকে বলে প্রেমের পূর্ণতা নাকি বিরহে। তবে মিলন-বিরহ যাই হোক না কেন যাকে ভালবাসা হয় তার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো উচিত। যাকে ভালবাসা যায় তাকে তো আর হয়রানী করা যায় না।
সাধারণত ছেলে ও মেয়েদের কিছু চাহিদা থাকে যার ভিত্তিতে তারা সঙ্গী বাছাই করে। নারীরা সঙ্গী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে যথাক্রমে যৌন চাহিদার পূর্ণতা, বিনোদনমূলক সঙ্গদান, চেহারার আকর্ষণীয়তা, গৃহস্থালী কাজের সহায়তা লাভ ও সম্মানপ্রাপ্তিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। অপরদিকে নারীরা স্নেহ ও ভালবাসা প্রাপ্তি, কথোপকথনের জুটি, সততা ও খোলামন, অর্থনৈতিক যোগান, পারিবারিক প্রতিশ্রুতি ইত্যাদিতে বেশি মনোযোগী হয়। আবার ছেলেরা কাউকে পছন্দ করার সময় দর্শন ইন্দ্রিয়কে প্রাধান্য দেয় আর মেয়েরা শ্রবণ ইন্দ্রিয়কে। তবে পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদির সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থির মাপকাঠি নির্ণয় অসম্ভব।
আসলে কি ঘটে যখন আমরা প্রেমে পড়ি? নির্দিষ্ট কিছু উত্তেজনার ফলে, হাইপোথ্যালামাস থেকে শক্তিশালী এন্ডরফিন্স নির্গত হয় নির্দিষ্টভাবে কেন তা পুরুষ বা মহিলার বেলায় ঘটে? সেখানে কি এমন গন্ধহীন ফোরামেন প্রবাহিত হয় যেটা আমাদের সম্মতিসূচক জিনগত সংকেত বহন করে? নাকি এটা একটা শারীরিক বৈশিষ্ট্য যেটা আমরা চিনতে পারি? একজন মায়ের চোখে যে গন্ধটা একটা সুখের চেতনা ধারণ করে ভালবাসা কি একটা পরিকল্পনার অংশ? দুই প্রজনন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটা বিশাল যুদ্ধ পরিকল্পনা? ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাসের মাঝে অযৌন অর্গানিজম হয় প্রত্যেকটা কোষ বিভাজন, বহুগুণ হওয়া, আমাদের চাইতে তারা দ্রুত পরিপক্ক ও সুন্দরভাবে বড় হয় এর বিরুদ্ধে আমরা সব থেকে ভয়ংকর অস্ত্র দিয়ে সাড়া দেই সঙ্গম দুই আলাদা ব্যক্তির জিনগুলো মিশ্রণের ফলে, কার্ড পরিবর্তন করে ও একজন নতুন ব্যক্তি তৈরি করে যে কিনা ভাইরাসকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিরোধ করতে পারে বাচ্চাটা আরো বৈসাদৃশ্যপূর্ণ হয় এখন, আমাদের দুই প্রজনন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যুদ্ধের ফলে একজন অজানা অংশগ্রহণকারী থাকে?- মি. নোবডি ছবিতে উল্লেখিত এই কথাগুলোর মতই কাজগুলো ঘটে
যাই হোক অন্যের কথা অনেক হল এবার আমার একটি মৌলিক মতামত বলি। প্রথমেই বলি আমি প্রথম দর্শনে ভালবাসায় ততটা বিশ্বাসী না যদিও যারা শেক্সপীয়র অনুরাগী তারা এটা মানবেন না। আমার মতে ভালবাসাটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন নয় বরং ধীর বিবর্তন। দ্বিতীয়ত আমার মনে হয় একজন নারী ও একজন পুরুষ যদি সবার সাথে থেকেও নিজেদের বন্ধুত্ব আলাদা করে রাখে অর্থাৎ একজন আরেকজনকে নিজের অজান্তেই অন্যদের তুলনায় বেশি গুরুত্ব দেয় তবে তারা চাক বা না চাক তাদের এই বন্ধুত্ব এক সময় প্রেমে রূপ নেবেই। তৃতীয় কোন এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুচক্রে যদি নারী-পুরুষের অনুপাত হয় ১:২ তাহলে ছেলে দুজনের মধ্যে জন্ম নেবে কম-বেশি শত্রুতা আর নারী-পুরুষের অনুপাত ২:১ হলে নারী দুজনের মধ্যে জন্মাবে ঈর্ষা তা তারা স্বীকার করুক বা না করুক। চতুর্থত কোন ভালবাসাই একই রকম থাকে না; সময়ের বিবর্তনে তার জৌলুসহানি হয়। এক সময় ভালবাসার জায়গা দখল করে নেয় দায়িত্বশীলতা, অসহায়ত্ব, দায়বদ্ধতা, সামাজিক লজ্জাবশত বাধ্যকতা ও এ জাতীয় অনুভূতি। পঞ্চমত ভালবাসা একটি অযৌক্তিক বিষয়আপনি যুক্তি দিয়ে একে থামাতেও পারবেন না আবার প্রয়োগ করতেও পারবেন না। ধরুন একজনকে আপনি ভালবাসছেন যাকে আপনার পক্ষে কোনদিনও পাওয়া হবে না আপনি জানেন তবু আপনি আপনার মনকে প্রবোধ দিতে পারবেন না। যাকে আপনি খুব ভালবাসছেন তার কোন আচরণ আপনাকে তাকে ঘৃণা করা শুরু করাতে পারে। এমনও হতে পারে যে এক সকালে উঠে আচমকা আপনি আবিষ্কার করলেন যে আপনার সবচেয়ে ঘৃণিত লোকটিকে আপনি ভালবাসতে শুরু করেছেন। ভালবাসা অনেকটা ঐশীবাণীর মত হঠাৎ এসে আপনার অতিথি হবে। তবু এটিই সবচেয়ে শুদ্ধ ও সুন্দর অনুভূতি।
অনেক নিরাশাবাদীর মুখে সুবীর নন্দীর ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন রেখে একটি কথাই শুধু জেনেছি আমি পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’ শুনে আপনি ভাববেন না যে ‘প্রেমের মরা জলে ডোবে না’। ভালবাসা সম্পর্কে প্রেম করা বা না করা উভয় পক্ষীয়দের সাবধানবাণী থেকে মনে হয় ভালবাসা ‘দিল্লী কা লাড্ডু’র মত যা খেলেও পস্তাবেন, না খেলেও পস্তাবেন। তাই খেয়ে পস্তানোই বোধ করি ভাল।

1 টি মন্তব্য: