মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

পন্তি অথবা কর্মজীবনে একটি বিচ্ছেদের গল্প...........
রুপন্তি অথবা কর্মজীবনে একটি বিচ্ছেদের গল্প.........

খুব অল্প বয়সে, মাত্র ২০বছর ৮ মাস যখন বয়স, যোগদান করলাম একটা কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে। জয়পুরহাট কালাই এর প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায়। বয়সের তুলনায় বেশি অপরিপক্ব r বেশি আবেগী। তাই এত দূর আসায় ভ্রমনের আনন্দের চেয়ে বন্ধু বিরহে মন বেশি কাতর।মনে হচ্ছে এত ছোট বয়সে চাকরী না নিলেও হত। আগে থেকেই প্রজেক্ট ম্যানেজানের সাথে কথা বলা আছে। আমি নামলেই অফিস নাইট গার্ড বাবলু ভাই আমাকে বাকি সব দেখিয়ে দিবেন। ঠিকানা শুধু লেখা ছিল জয়পুরহাট কালাই। ভাল করে জানার জন্য এ্যাডমিন অফিসারকে ফোনডী কিন্তু আমি শুনলাম পরিচিত এক জায়গা মোকামতলা। অনেক উল্টা পথ ঘুরলাম তবু কানকে দোষ দিলাম না। ওর আর দুষ কি? ও কি কখনো মোলামগাডী নাম শুনছে? তাই পরিচিত শব্দ মোকামতলাকেই ভেবে নিয়েছে। কালাই নেমে মোলামগাডী পর্যন্ত যেতে অনেকটা পথ ভ্যান এ গেলাম। চারদিকে শুধু মাটির ঘর।মাটির দুতলা ঘরগুলো দেখে অবাক হলাম। উচু ঘর মাঝে বাস দিয়ে মাচা করা তার উপরে আলু-ধান-গম রাখে। মানুষও থাকে। মাটির তৈরী দেয়ালে সুন্দর করে রং দিয়ে আলপনা আঁকা।মাটির ঘর আর তার আলপনা যতটা আমাকে মুগ্ধ করল মাটির রাস্তাঘাট ততটা মুগ্ধ করল না। তাই মা যখন জানতে চাইল মাকে বললাম গ্রামটা খুবই গরিব।কিন্তু বাবলু ভাই সারাদিন আমাকে নিয়ে ঘুরাফেরা করার পর, মাছের বড়বড় মাথা খাওয়ানোর পর মাকে আবার ফোন করলাম।মাকে বললাম ওরা গরিব কিন্তু অনেক ভালো মানুষ।মা বলল মানুষ চেনা কঠিন, বাইরে গেছ ধীরে ধীরে চিনবা।সত্যি ধীরে ধীরে আমি মানুষ চিনলাম।কিন্তু মা যে সুরে বলেছিল তার থেকে ভিন্ন সুরে। দিন গেছে মানুষগুলোকে আরও আপন মনে হয়েছে। বাবলু ভাই আমাকে নিয়ে সারাদিন বাসা খুজলেন। অনেক ভালো ভালো বাসা পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু আমার পছন্দ হচ্ছে না। অবশেষে আমি যেটা পছন্দ করলাম সেটা বাবলু ভাইয়ের পছন্দ না। কারন ঐ বাসাটা ফাকা।কেউ থাকে না।হাফ বিল্ডিং।মানে ইটের দেয়াল টিনের চালা।বাসায় ডিসের লাইন নেই,পানি তুলার মটর নেই,চুরের উৎপাত,পাশে জমিতে পানি দেওয়ার মেশিন চলবে,রাতে পিছনে এলাকার লোকজন তাস খেলবে।কিন্তু আমি এটাতেই উঠলাম কারন এমন ফাঁকা একটা বাসাই আমি খুজছিলাম। আমি একা থাকতে চাই।
বাসায় ডিসের লাইন আনলাম,পানি তুলতে মটর বসালাম,বাইরে বাতি জ্বালিয়ে রাখলাম ফলে চুর আর তাস খেলোয়াররা কায়দা করতে পারল না।কিন্তু আমার আর একা থাকা হল না।কারন মানুষ ভালবাসা আর ভালো বাসার কাঙ্গাল। প্রথমে একটা পরিবার উঠল। কিন্তু আমার তেমন সমস্যা হল না। কারন দিনের বেলায় আমি প্রায় একাই থাকতাম। উনারা দুজনেই বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকত। কিছুদিন ভালই যাচ্ছিল কিন্তু আমার যে সব কিছু ভাল যায় না।এখানেই তার ব্যতিক্রম হবে কেন?
হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই বাডির মালিক তার মেয়ে নাতনী নিয়ে হাজির। অবশ্য বাডির মালিক আমাকে জানিয়ে তার নিজের বাডিতে আসবে এমনটা আশা করিই ba কেমনে? সবাইকেই বিরক্তি লাগত কিন্তু বাসা মালিকের নাতনীর জ্বালাতনটা আরো বেশি, অসহ্য।তার জ্বালাতনের ধরণ একেক দিন একেক রকম। কোনিদন সে তার ছোট ছোট পাতিলে ধুলা বালি আর ঘাস লতাপাতা দিয়ে ভাত তরকারি রান্না করবে আর তা খেতে হবে আমাকে।কোনদিন সে কোন গাছে একটা ফুল দেখে এসে বায়না ধরবে তা এনে দিতে হবে।আমি ঘুমাব আর সে আমার রুমে টিভিতে কার্টুন দেখবে।মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে মনে হত বাসায় যাব না। কিন্তু বাইরেও থাকা হয় কম। বাজারে শুধু মামুন ভাইয়ের দোকানেই বসি তাও খুব অল্প সময়ের জন্য। প্রথম দিকে অন্য কাউকে চিনতাম ও না তাই বাধ্য হয়েই বিরক্তিগুলো সহ্য করা শুরু করলাম। তাছাড় ছোটদের আমি অনেক পছন্দ করি।বিশেষ করে তাদের সরলতাকে আমার ভাল লাগে।যা বুঝাব তাই বুঝবে এমন টাইপের পিচ্চিদের। যেমন কোন পিচ্চি বাদাম খাচ্ছে তার সামনে গিয়ে বাদামের সাথে শুকনো গাছ সহ বাদাম দেখিয়ে বলব দেখ ,এই বাদামগুলো খেও না।খেলে পেটে গাছ হবে।তার চেয়ে আমাকে দিয়ে দাও, আমি রোপন করি। গাছ হলে অনেক বাদাম হবে তখন আমরা মজা করে অনেক গুলো বাদাম খেতে পারব। আর সে সহজ সরল ভাবে দিয়ে দিবে। অথবা কোন পিচ্চির সাথে বাদাম খাচ্চি ইচ্ছে করেই কিছু বাদাম, বাদামের খোসার ভিতর ফেলে দিব পিচ্চি বুঝতেও পারবে না। পরে সেগুলো আলাদা করে আমি খাব।কিন্তু আমার বাসার এই পিচ্ছি আমার চেয়েও চালাক।কেমন চালাক তার নমুনা দেই। আমি একটা জাদু জানি। সিগারেট পুড়িয়ে তা থেকে টাকা বের করা। যা আমি কয়েকজন কে দেখিয়ে ভালই সুনাম অর্জন করেছি। এই পিচ্চি কার কাছ থেকে শুনছে আমি জানি না। শনিবার আমার অফিস বন্ধ। দুপুরে খেয়ে ঘুমাবো এমন সময় আপদটা এসে হাজির।তার একটাই বায়না সে জাদু দেখবেই। কতক্ষন না না করে যখন বুঝলাম কোন কাজ হবে না এর চেয়ে বরং জাদু দেখিয়ে বিদায় করাই ভালো তখন উঠলাম। এই জাদু দেখানোর জন্য আমি আগেই কিছু সিগারেটের ভিতর থেকে তামাক বের করে টাকা সুন্দর করে গোল করে পেঁচিয়ে সিগারেটে ভরে রেখেছি। যখন দেখাই তখন সেখান থেকে সিগারেট নেই। এই আপদটাকে বিদায় করতেও আমি যথারিতি তাই করলাম। আগুন ধরিয়ে কিছুটা পুরিয়ে হাতের মুঠোয় নিয়ে কিছুক্ষন হাত কচলিয়ে সিগারেটের ভিতর থেকে টাকা বের করে দেখালাম।ও মনোযোগ দিয়ে দেখল।জাদু শেষ হওয়ার পর আমি বললাম এবার আমি ঘুমাব তুমি যাও। ওর এক কথা তুমি ঘুমাও আমি পরে যাব।বিরক্ত হয়ে আমি পাশ ফিরে ঘুমালাম।কতক্ষন ঘুমালাম জানিনা তবে ঘুম যে পরিপূর্ণ হয়নি তা বুঝতে পারলাম। কারন এমন ডেন্জারাস একটা পিচ্চি পাশে রেখে নিশ্চিন্তে পরিপূর্ণ ঘুম হয়না।
আমি উঠেই পিচ্চিটার খোজ করলাম। তারপর আমার সিগারেটের খোজ নিলাম। দুইটাই লাপাত্তা। আমি জানি ওকে কোথাকোথা পাওয়া যেতে পারে।কিন্তু সেখানে সে নাই। তার খেলাধুলা করার সমস্ত হাডিপাতিল পরে আছে আর পরে আছে আমার খেলা দেখানোর তামাক ছাড়া সিগারেটের ছেড়া ছেড়া অংশ। তবে মাত্র কয়েকটা তাই আমি বাকিগুলো রক্ষা করতে খুজতে লাগলাম। অনেক কষ্টে তাকে খুজে পেলাম। অনেকগুলো পিচ্চির মাঝে দারিয়ে আছে। দুর হতে ভাবলাম হয়ত ও জাদু দেখাচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখি ওরে বাবা রিতিমত মাস্টারনি ভূমিকায় সে অন্য পিচ্চিদের সিগারেট দিয়ে কীভাবে টাকা বানাতে হয় তাই শিখাচ্ছে।
এরপর কয়েকটা দিন পিচ্চিটাকে দেখলেই রাগ হচ্ছিল। টাকা আর সিগারেট গুলো নষ্ট হয়েছে এই জন্য নয় রাগ হচ্ছিল আমার জাদুর ঘোমর ফাস করে দেওয়ায়। আমার জাদু এখন পাঁচ-সাত বছরের শিশুরাও পারে পার্থক্য শুধু আমার মত এত সুন্দর করে সিগারেট এ টাকা ভরতে পারেনা। অশব্য তাতে আরেক সমস্যা সিগারেটে টাকা ভরে দেওয়ার বায়না মিটাতে হয় যখন তখন
ও বড হয়েছে ঢাকায় তাই গ্রাম আর ঢাকায় বড় হওয়া দুটি শিশুর কত পার্থক্য হয় ওকে দেখে আমি বুঝেছি। এই বয়সেই ফটাফট ইংরেজি বলে। পোশাকেও আধুনিকতার ছোয়া। লেখাপড়া আঁকাআঁকি গান নাচ কি পায় না ও। ও এত কিছু পারার মাঝে আর যা বেশি পারে তা হল মানুষকে বিরক্ত করা।কোন কিছু ভুল করলে সেটা বলে সারাবাড়ি মাথায় নেওয়া। সবাইকে বলে সবার সামনে লজ্জায় ফেলা। আমি দেখতে না চাইলেও জুর করে ওর আঁকানো খাতা দেখানো। ওর মুখস্থ সব কবিতা ভাল না লাগলেও জুর করে শুনা।
এত এত বিরক্তিকর মাঝে আরও যেটা বিরক্তিকর ছিল সেটা হচ্ছে আমি অগোছালো আর এটা নিয়ে ওর ভালো না লাগার কথা শুনা।আংকেল তুমি এত অগুছালো কেন? রুমে ডুকে এইটাই ছিল তার প্রথম কথা।মনে হয় আমি যেমন ওর প্রতি বিরক্ত আমার অগোছালো কাপড়চোপড় দেখে ও আমার প্রতি তার চেয়ে বেশি বিরক্ত। মাঝে দেখতাম টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খাতা কলম বই এটা সেটা ও নিজেই গুছিয়ে রাখছে। ওর এটাও বিরক্তিকর কারন পরে দরকারের সময় আমি আর এগুলো খুজে পেতাম না । একদিন দুপুরে ঘুমাব ও এসে জ্বলাতন করতে লাগল।আগের রাতে ভালো ঘুম হয়নি।দিনেও ঘুম হচ্ছে না।তারমাঝে ওকে কেমন যেন মুটেই সহ্য হচ্ছিল না।তাই জুরে কঠিন সুরে চলে যেতে বললাম।ও যে এত সহজে কাদবে আমি বুঝতে পারিনি।ও কোন কথা না বলে নিঃশব্দে চোখে পানি এনে ফোপিয়ে ফোপিয়ে কেদে চলে গেল।আমি সারাটা বিকেল শুয়ে রইলাম কিন্তু ঘুম এল না।শুধু মনে হল কাজটা ঠিক হইনি।এত ছোট একটা পিচচি কে এবাবে কষ্ট দেওয়া ঠিক হলনা।আবার ভয় হল ওর মা বা নানীকে কিছু বলল কিনা।আমি সন্ধ্যায় বের হলাম আশেপাশে খুজলাম কিন্তু পেলাম না।পরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার আগেও ওকে পেলাম না।অফিস থেকে এসেও পেলাম না।কেমন যেন ওকে খুজে পাওয়ার ইচ্ছা আমাকে জেকে ধরল।মনে হচ্ছে খুজে পেতেই হবে।তাই সব দ্বিধা বাদ দিয়ে ওর মার কাছে জানতে চাইলাম রুপন্তি কই।ও বলাই হয়নি পিচ্চিটার নাম রুপন্তি।তবে ওর মা ওকে রুপ বলে ডাকে।
ওর মা বলল ও তো ঘরেই।আমি বুঝলাম ও এত কষ্ট পেয়েছে যে ঘরেও আর জুরে কথা বলে না। আমি ধীরে ধীরে ওর রুমে ডুকলাম।দেখি ও ছবি আকাচ্ছে আমি যেতেই ছবি আকানো বাদ দিয়ে সব গুছাতে শুরু করল।আমি বললাম কি আকালে আমাকে দেখাবেনা? ওর কোন কথা নাই।আমি আরো অনেক কিছু বললাম কিছুতেই ও কথা বলে না পরে যখন বললাম ঠিক আছে তুমি যেহেতু আমার সাথে কথা বলবে না আমি তাহলে তোমাদের বাসায় আর থাকব না।বলে চলে আসব এমন সসময় ও তাহলে সরি বল।
ধীরেধীরে রুপন্তি কে আমার ভাল লাগতে শুরু করে।এখন আর ওর ধুলাবালির রান্না খেতে আমার আর বিরক্ত লাগে না।আমি বরং ওর কাছে চেয়ে চেয়ে দাওয়াত নেই।ও বলে এর পর দাওয়াত খেতে আসলে খালি হাতে আসা যাবেনা।মিষ্টি আনতে হবে। টিভিতে ওর কার্টুন দেখা আমার খারাপ লাগেনা।আমি অবাক হয়ে লক্ষ করি আমিও টম & জেরীর ভক্ত হয়ে গেছি।টম আর জেরীর দুষ্টামি দেখে রুপন্তির সাথে হাসতে হাসতে ওর গায়ে লুটিয়ে পডি। মাঝেমাঝে খেলা দেখা বাদ দিয়ে ওর জন্য আমি কার্টুন দেখি যা আমার ক্ষেত্রে ভাবা যায় না।যে আমি দুনিয়া উল্টে গেলেও খেলা দেখা মিস করি না সেই আমি শুধু মাত্র রুপন্তিকে খুশি রাখতে খেলা দেখা বাদ দিয়ে কার্টুন দেখি। মাঝেমাঝে বাজার থেকে চানাচুর বিস্কিট চকলেট এনে ওকে দেই।ওর মা বা নানী জানতে চাইলে বলি অফিস থেকে দিয়েছিল।আমি খাইনা তাই। জানি না কেন এতটা ভালবেসে ফেলি পিচ্চিটাকে।হয়ত আমার কোন ছোট বোন নাই অথবা ছোটদের ভালবাসলেও তাদের এতটা কাছাকাছি এই পথম তাই।অনেক আনন্দে কাটছিল দিন গুলো।সারাদিন অফিসের শেষেই সোজা চলে আসতাম বাসায়।এসেই রুপন্তিকে খোজ করতাম।কোনদিন না পেলে মনটা খারাপ হয়ে যেত কাউকে বুঝতে দিতাম না।অথচ এই রুপন্তিকেই আমি হারালাম।হঠাৎ একদিন অফিস থেকে এসে দেখি ওরা ওদের কাপড় চোপড় ব্যাগ পত্তর গোচাচ্ছে।আমি বুঝতে না পেরে রুপন্তিকে ডাকলাম।রুপন্তি জানাল ওরা আগামীকাল আবার ঢাকা চলে যাচ্ছে।আমি সঙ্গেসঙ্গে জানতে চাইলাম কবে আসবে।ও যা বলল তাতে হতাস হলাম।মাস খানেক পর আসবে।রুপন্তি চলে যাওয়ার পর আবার সেই একা হয়ে গেলাম।যে একাকে আমি ভালবাসতাম।যে একা থাকতে আমি এমন ভুতুরে বাড়ী ভাড়া নিয়েছিলাম সেই একাটাই এখন আমি সহ্য করতে পারিনা।আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।মাঝে মাঝে ওর রান্না করার জায়গাটা তাকিয়ে দেখি।ওখানে বসি। মাঝে মাঝে একা একা কার্টুন দেখি আর ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাই কবে মাসটা পারি হবে কিন্তু মাস আর পারি হয়না বরং আমার বদলীর নোটিশ আসে।আমি চলে আসি দিনাজপুরে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন