না, আমরা সত্যি সত্যি রকেটে করে মুক্তিবেগে পৃথিবী ছেড়ে চাঁদে যাইনি এমনকি
আফ্রিকার দেশ চাদেও যাইনি; আমরা গিয়েছিলাম চাঁদপুর। তবে আমরা নীল আর্মস্ট্রং বা
চাদ/শাদের রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ে কম আনন্দ পাইনি এটা বলাই বাহুল্য।
কয়েকদিন থেকেই মনে বাজছিল হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথাও। ১২ মে ক্লাস করে
রুমে এসে দেখি জাকিয়ার ফোন। ও প্রান্ত থেকে নির্দেশ এলো হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে
কয়েকজন মিলে বিকেলে চাঁদপুর যাবে, আমাকেও যেতে হবে। সঙ্গী হিসেবে আছে রাহুল, আঁখি,
মামুন, সুপ্তি ও জাকিয়া। তাই ভাবলাম জুটিতে কাবাবের হাড্ডি হয়ে যাওয়ার চেয়ে কথা
বলার জন্য সঙ্গী মুজাহিদকে নিয়ে যাই। যেই কথা সেই কাজ, মুজাহিদকে ফোন দিলাম।
কিন্তু সম্ভবত ওর বয়সজনিত দুর্বলতা বিকেলে না যাওয়ার পক্ষে রায় দিল। আমিও আবেশ
প্রক্রিয়ায় না বলে দিলাম। পরে ওরা আবার ফোন দিয়ে জানাল যে যাত্রা শুরু রাতে। আমিও
আবার মুজাহিদকে নক করলাম। ও বলল ঠিক আছে। আমিও তাই সম্মতি দিলাম। রাতে সব কাপড়
চোপড় গুছিয়ে বের হওয়ার সময় শুনি মুজা বেঁকে বসেছে। ওর আবার সকালে যে যুক্তি দেবে
রাতে তা খন্ডানোর বিরল বদ অভ্যাস আছে। আমি সহযাত্রীদের জানিয়ে দিলাম আমি যাচ্ছি
না। কিন্তু মানুষ ঈশ্বরের কথা না শুনলেও নারীদের কথা ঠিকই শোনে। তাই জাকিয়ার ফোনে
মুজা রাজি হয়ে গেল। ফলে রাত ১০টার দিকে জগন্নাথ হলের সাক্ষাৎপ্রার্থীদের কক্ষ থেকে
রিক্সাযোগে সদরঘাট রওনা দিলাম। নামার পর রিক্সাওয়ালা নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি
নিল। প্রলিটারিয়েটদের অধিকার তো আর ক্ষুণ্ন করা যায় না! দরকারি জিনিস কিনে টিকেট
কেটে ভিতরে ঢুকলাম। আমি আগে জানতাম যে ঐতিহাসিক দর্শনীয় জায়গায় যেতে টিকেট কাটতে
হয়। কিন্তু এখানে এসে আমার ভুল ভাঙ্গল। আর ঢুকেই মনে পড়ে গেল বহুল চর্চিত প্রবাদ ‘বাইরে
ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট’। কিন্তু আমাদের কয়েকজন ঢুকেই ছবি তোলা শুরু করল।
হায়রে ফেইসবুক, সবাইরকে মডেল করেই ছাড়ল!
সাগর পেরোলে নাকি জাত যায়। আমার এই প্রথম লঞ্চ ভ্রমণেও সে আশঙ্কা ছিল।
কিন্তু দুঃখী জাত গিয়ে যদি সুখী জাতিতে পরিবর্তিই হলে মনে হয় মন্দ হত না। তবে
কষ্টের উপাদানকে মুজার কথা মত ঢাকায়ই রেখে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। রফ রফ লঞ্চে উঠেই
একটি বিচ্ছিন্ন অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটল। তারপর আমাদের আপাত-স্থায়ী ঠিকানা হল ২৩১ ও ৩২৩
নং কেবিন। দ্বিতীয়টি ছিল তিন তলায় আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এই ভ্রমণটি কারো জন্য ছিল
অভিযান আর কারো জন্য অভিসার। বলতেই হয় না আমি ১ম দলেরই লোক। তাই লঞ্চের রেলিং ধরে
উচ্চ স্বরে গান গেয়ে, এসি রুমে তাস খেলে সময় পার করলাম। আমার জীবনের বিনিদ্র রজনীর
আর্কাইভে জায়গা করে নিল আরেকটি রাত। ভোরের দিকে একটু চোখ বুজে ঘুমের ভান করলাম
যেটা আবার মুজার মতে রোমান্টিক ঘুম নাম নিল।
ইচলীতে নামলাম সকালে। নেমেই সেখান থেকে সিএনজি করে গেলাম নীল কুঠিবাড়ীতে।
কুঠিবাড়ী থেকে ফিরে ডাকাতিয়া নদীর উপর ব্রিজের পাশে নেমে নাস্তা করলাম। তারপর চীনা
বাড়ীর পাশ দিয়ে গেলাম নৌকা ঘাটে। সেখান থেকে নৌকা করে তিন নদীর মোহনায় গেলাম।
পিচ্ছিল কংক্রিটে পিছলে গিয়ে রক্তাক্ত হল মামুন। তবে জায়গাটা অনিন্দ্য সুন্দর।
বাতাস আর পানির এক অপূর্ব মিথষ্ক্রিয়া আমাকে মাতিয়ে দিল।
এরপর আবার ইঞ্জিনচালিত নৌকায় গেলাম চরে। চরে চরছিল একটি গরু। তার সাথে ছবি
তুলল মুজাহিদ ও মামুন। চরে ল্যান্ড করেই আমরা ক্ষান্ত হলাম না আমদের তাড়নে জলও
আন্দোলিত হল প্রবলভাবে। এখানে কয়েকজন গোসল করলাম নদীতে আর
অনেক দিন পর সাঁতার কাটার সুযোগ পেলাম। গোসল সেরে আবার ইঞ্জিনচালিত নৌকাটিতে
উঠলাম। এবার গন্তব্য ইচলী ঘাট। ভেজা কাপড়গুলো সবাই শুকাতে দিয়েছিল নৌকার উপর।
কিন্তু জায়গা সংকটের জন্য আমি আমার র্যাগ ডের পোলো শার্টটি শুকাতে দিয়েছিলাম
নৌকার ছাউনিতে। বায়ুর দেবতা রুষ্ট হলেন। তাই প্রচন্ড বাতাসে আমার র্যাগ ডের পোলো
শার্টটি উড়ে গেল মাঝ নদীতে। আমি আর তোলার কোন উদ্যোগও নিলাম না। যাক র্যাগ
সংক্রান্ত সকল স্মৃতি মুছে যাক। র্যাগ ডের প্রথম দিন ভাঙ্গল আমার রোদচশমা এরপর
দ্বিতীয় দিন ছিঁড়ে গেল ঘড়ির বেল্ট। আর তার চেয়ে বড় কষ্ট র্যাগ ডে শেষ হওয়ার পর
আমি হারালাম সুখী হওয়ার কারণ। তাই র্যাগ ডে সম্পর্কিত সবকিছু হারিয়েই যাক না হলে
কষ্টগুলো নবায়ন হয় অনেক গুণে।
ফেরার সময় রাত জেগে সারাদিনের ক্লান্তি আমার শরীরে জেঁকে বসল। তার সাথে দূর
হয়ে গেল নতুন কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের উত্তেজনা। ফলে ডেকে শরণার্থীর মত শুয়ে ঘুমিয়ে
পড়লাম। তখন বুঝলাম খাইরুল স্যারের ক্লাসে পড়া গ্লোবালাইজেশনের মাহাত্য। বিশ্বায়ন সব দেশকে একই জাহাজে তোলে কিন্তু কাউকে কেবিনে রাখে আর কাউকে ডেকে। আমার প্রথম লঞ্চ
ভ্রমণ আমার এই দুই অভিজ্ঞতার তুলনামূলক বিশ্লেষণের সুযোগ করে দিল। তবে সব মিলিয়ে
সময়টা খারাপ কাটল এটা বলা বোধ করি ঠিক হবে না।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন