প্রতি শতাব্দীতেই কিছু কিছু মানুষ আবির্ভূত হন যারা
স্থান কাল পাত্রের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বের সম্পদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এদের
মধ্যে একজন চে। যারা ফুটবলে আর্জেন্টিনা সমর্থন করেন তারা অনেকেই জানেন না যে এর্নেস্টো
চে গেভারা দে লা সের্না (১৪ জুন ১৯২৮ – ৯ অক্টোবর ১৯৬৭)-এর জন্মভূমি
আর্জেন্টিনা। কিন্তু তারা জানুন বা না জানুন চে কিন্তু সুদূর ল্যাটিন আমেরিকা ছেড়ে
ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই মৃত্যুর পরও আমার আপনার দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছেন। কিন্তু
দুর্ভাগ্যের বিষয় হল আমরা আমাদের জাতীয় নায়কদের না চিনে বিদেশীদের নিয়ে মাতামাতি
বেশিই করি। এ জন্যই বলা হয় বাঙালির ইতিহাস সচেতনতা নেই ফলে বাঙালি মানুষ হচ্ছে না।
আমরা আজ যাকে বাংলাদেশ বলছি তার নামকরণ করার জন্য জন্ম হয়েছিল এমন একজন যাদুকরী
নেতার যিনি অনুসারীদের একচক্ষু দৃষ্টিভঙ্গির জন্য আজ বিশ্বমানের নেতা হয়েও কয়েকটি
আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান, স্থাপত্য
ভবনের নামে বন্দী অবস্থায় দলীয় বলয়ে আবদ্ধ হয়ে অসম্মানিত হচ্ছেন। তাঁকে আর নতুন
করে পরিচিত করানোর কিছুই নেই, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর
রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০ – ১৫ আগস্ট ১৯৭৫)। তাঁকে নির্দেশ করতে কোন উপাধির
প্রয়োজন হয় না, কেননা শেখ মুজিব মানেই
বাংলাদেশ। আর রবি ঠাকুরের মত দেশ মাটিতে তৈরি নয়, দেশ
মানুষে তৈরি। তাই কোন বাঙ্গালিকে যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে চেনাতে দ্বিতীয় কোন কথা
বলতে হয়, তবে তা হবে জাতির জন্য কলঙ্কজনক।
বর্তমান পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধু আজও প্রাসঙ্গিক, তাঁর
চিন্তাধারা আধুনিক ও সমসাময়িক। তাই তাঁকে নিয়ে প্রচুর চর্চা করা দরকার। কিন্তু
দুঃখের বিষয় হল তাঁকে নিয়ে লেখা বইগুলো এক শ্রেণির লোকের কাছে গ্রহণযোগ্যই নয়; এর
পিছনে অবশ্য বাঙ্গালির অতি আবেগময়তার পরোক্ষ প্রভাবও আছে। তবে শেখ মুজিবের মাঝে
ছিলেন একজন নেলসন ম্যান্ডেলা। কেননা তিনিও
ছিলেন অন্যায়ে আপোষহীন, স্বাধীনতার পথে তিনিও হেঁটেছেন দীর্ঘপথ, ভোগ করেছেন ১৪ বছরের কারাবাস। তবু তাঁর মধ্যে দেখা যায় স্থির সৌম্য এক
গান্ধীর প্রতিচিত্র। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেছেন, “আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালাইয়া যাইব”। আবার মুক্ত স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ১০ জানুয়ারির বক্তব্যে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে তাঁর অভয়
বাণী, “তোমরা আমার লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা
করেছ, মা-বোনদের ইজ্জত লুন্ঠন করেছ, অসংখ্য বাড়িঘর জ্বালিয়েছ এবং আমার কোটি কোটি মানুষকে তাড়িয়ে দিয়ে ভারতে
যেতে বাধ্য করেছ। এরপরও আমি তোমাদের প্রতি কোনরূপ বিদ্বেষ পোষণ করি না।” অপরদিকে
দেশ স্বাধীন হবার পর তাঁর বাণী, “আমি সাহায্য চাই কিন্তু
স্বাধীনতা বিক্রি করে সাহায্য চাই না” এবং তাঁর ট্র্যাজিক মৃত্যু চের কথা মনে
করিয়ে দেয়। অনেকের অনেক গুণাবলি তাঁর মাঝে সুষম অনুপাতে মিশে তাঁকে এক স্বতন্ত্র
নেতায় পরিণত করেছিল। ফলে তিনি রাজনীতিতে সমাজতন্ত্রের পথ ধরে গণতন্ত্রে উপনীত
হয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন ধর্ম নিরপেক্ষতার যা আজও অর্জন করতে আমরা
ব্যর্থ। মানুষের ভালবাসাই ছিল তাঁর বড় শক্তি। তিনি মানুষকে অন্ধভাবে ভালবাসতে
পারতেন। ৭ মার্চের ভাষণে দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেন, “আমি
প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের মুক্তি চাই।” এ কথার সত্যতা
হিসেবে রাজনৈতিক কূটচালের স্বীকার হয়ে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ
আঁকড়ে ধরার ইতিহাস তাঁর আছে। ’৭০ এর নির্বাচনের আগ মুহূর্তে নির্বাচনী প্রচারণা
ছেড়ে মানবতার ডাকে সামুদ্রিক ঝড় গোর্কি আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে
তাঁকে। যেখানে ১০ লাখ লোক নিহত হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের কোন দৃষ্টিপাত ছিল না।
লায়ালপুর সামরিক কারাগারে তাঁর সেলের সামনেই যখন তাঁর নিজের কবর খোঁড়া হচ্ছিল তখনও
তিনি পরিবার পরিজন ছেড়ে দেশের কথা ভাবছিলেন। তিনি মৃত্যুদন্ড শুনেও খুশি ছিলেন
কেননা তিনি ভেবেছিলেন তাঁর কবরের উপর দিয়েই আসবে বাংলার স্বাধীনতা। তিনি শুধু
চেয়েছিলেন তাঁর মৃতদেহ যেন জনগণকে দেয়া হয়। এত ভালবাসার বিনিময়ে ভালবাসাও জনগণের
পক্ষ থেকে তিনি কম পান নি। তাই তো যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর তিনি সর্বকনিষ্ঠ
মন্ত্রী হিসেবে সমবায় ও কৃষিঋণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এমনকি, পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা নাসের, যাকে বঙ্গবন্ধুকে বৈকালিক ভ্রমণে হাঁটার সময় গুলি করে মেরে পালানোর
চেষ্টায় মৃত্যু গুজব ছড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সেও পাকিস্তান সরকারের নোংরা কৌশল
বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করে তার নিজের জীবন উৎসর্গ করে।
বঙ্গবন্ধুর বহুমুখিতা এতই বেশি যে তিনি নিজেই একটি
প্রতিষ্ঠান। তাঁকে নিয়ে আজও সঠিকভাবে নতুন প্রজন্মের সাধারণ মানুষের জানার সুযোগ কম।
যে শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্টের শিক্ষা ও বাণিজ্য মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ১৯৫৮ সালে ইস্ট
পাকিস্তান ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেখান থেকে তাঁর জীবনী
নিয়ে কোন ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র বা তথ্যচিত্র করা হয়েছে কিনা সেটি একটি খতিয়ে দেখার
বিষয়। এছাড়াও তাঁর
জীবনী আবেগের মেদ ছাড়া বস্তুনিষ্ঠ নিরপেক্ষভাবে লেখা নেই বললেই চলে। আমরা আজও তাঁর
প্রেমিক জীবন, রাজনীতির প্রথম দিককার
সাম্যবা, প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষতা, তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবনা, বৈশ্বিক কো-এক্সিসটেন্স সম্পর্কে কতটুকু জানি? আন্তর্জাতিক সাংবাদিক লোরেন জেঙ্কিন্স যাঁকে Poet of Politics বলেছেন, BBC বাংলা সার্ভিসের শ্রোতা জরিপ যাকে
সর্বকালের সর্বসেরা বাঙালির স্বীকৃতি দিয়েছে তাঁর সম্পর্কে ভাসা ভাসা কিছু তথ্য
জেনেই স্লোগান ধরাটা আমার কাছে খাপছাড়া মনে হয়। তাই সময় এসেছে শেখ মুজিবের জীবনের
অতল গভীরতায় ডুবে পরোক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মাধ্যমে তাঁকে অন্তরে ধারণ করার। কেননা
তিনি নিজেও করে শেখার পক্ষপাতী ছিলেন। অনেকে এখনো মুজিব হতে চায় কিন্তু স্বার্থচিন্তায়
বা ভয়ে সঠিক কথা বলতে পারে না। নতুন ভাবে মুজিব চর্চা হয়তো সমাজ পরিবর্তনের এই
সৃজনশীল অগ্রদূত মুক্তচিন্তানায়কদের মৃত্যুভয়ের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করতে পারে
চিরতরে।
গ্রন্থপঞ্জিঃ
1. অসমাপ্ত আত্মজীবনী
2. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- মনি হায়দার
3. জাতির জনক বঙ্গবন্ধু- শাহজাহান কিবরিয়া
4. কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, আগস্ট ২০১৫
ভালো লাগলো
উত্তরমুছুন