রবিবার, ২৬ জুন, ২০১৬

বাংলা Vs. English

শিরোনাম দেখে আঁতকে উঠার কোন কারণ নেই। এ কারণেই বলছি যে, আমরা জাতি হিসেবে অনেক আবেগপ্রবণ। আর ভাষার ক্ষেত্রে আমাদের অনুভূতি প্রায় আকাশছোঁয়া। কারণ শুধু আমরাই বিশ্বের একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করেছি। আর ফেব্রুয়ারি মাস এলে তো আমাদের ক্ষণস্থায়ী ভাষাপ্রীতির অতিরিক্ত প্রদর্শনী মেলে কথাবার্তায়, বিজ্ঞাপনে, মোবাইল ফোনের রিংটোনে। কিন্তু ঐ মাসটি ব্যতীত এতসব প্রীতির নমুনা পাওয়া অত্যন্ত দুষ্কর। তবে দু:খের বিষয় হলো আমাদের গৌরবান্বিত ভাষা আন্দোলন ও ভাষা সম্পর্কে আমাদের বেশিরভাগ মানুষের জানাশোনা প্রায় শূণ্যের কোঠায়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হয়তো এজন্যই বলেছিলেন “বাঙ্গালীর ইতিহাস চাই। ইতিহাস ব্যতীত বাঙ্গালী মানুষ হইবে না।” যাহোক আমার আলোচনা বিষয়তো ইতিহাস নয় কারণ এটি বহুল আলোচিত ব্যাপার।

মূলত বাংলা ও ইংরেজী ভাষার আপাতদৃষ্ট বিতর্কই আমার আলোচ্য। বাংলা ভাষা হল পৃথিবীর সকল ভাষার ভেতর ভাষাভাষীর লোকসংখ্যার দিক থেকে চতুর্থ। আর ইংরেজী হল বিশ্বের সকল দেশের আন্ত:যোগাযোগের জন্য সর্বজনস্বীকৃত ভাষা। অন্যান্য দেশের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের সাধারণ মাধ্যম হল ইংরেজী ভাষা। তাই ইংরেজী ভাষা যে সব দেশের মাতৃভাষা নয় সেসব দেশে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি শেখা একটি বাঞ্ছনীয় বিষয়। কিন্তু অনেকে এ বাংলা ইংরেজির সহাবস্থান ভিন্নভাবে বর্ণনা করেন। তাদের মতে ইংরেজি ভাষায় লেখাপড়া কিংবা ইংরেজি ভাষা পড়ালেখা সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়ই না পাপসম। কিন্তু বৈশ্বিক দৃষ্টিতে ইংরেজির সমান্তরাল গতিশীলতা অবশ্যই প্রয়োজনীয়।

আবার অনেকেই হয়তো জানেই না ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারী বাংলা কত তারিখ ছিল। সেদিনটি ছিল ৮ই ফাল্গুন। অনেক কবি এটি তাদের কবিতায় উল্লেখ করেছেন। কিন্তু বাংলা ও ইংরেজি দিনপঞ্জি গণনার পার্থক্যের কারণ এখন ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয় ৯ই ফাল্গুন। যদি বাংলার বাধ্যবাধকতা এতই বেশি হতো তবে তো ২০ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু তা হবে না। কারণ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার বেশিরভাগ দেশে দিন গণনায় ব্যবহৃত হয় আর এতে দিন তারিখ আকবরীয় পঞ্জিকা সহ অন্যান্য পঞ্জিকার সঙ্গে গরমিল হয়। তাই এটি মানাই সমীচীন। অন্যদিকে বাংলা পঞ্জিকা মতে দিন শুরু ভোর থেকে হলেও বর্তমানে দিবসটির কার্যক্রম শুরু হয় রাত ১২টায় মানে ইংরেজী ক্যালেন্ডারের আদলে।

এছাড়াও আসে স্বীকৃতির বিষয়টি। ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেব স্বীকৃতি দেয় UNESCO তথা জাতিসংঘ ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। UNESCO এর স্বীকৃতি পত্রে লেখা ছিল- 21st February proclaimed International Mother Language Day through but the world to commemorate the martyrs who sacrifice their lives on the day 1952.

এতদ্ব্যতীত বিভিন্ন দেশে এর প্রচারণা বা উদযাপনের প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয় বেশিরভাগ ইংরেজিতে। তাছাড়া আমাদের ব্যাকরণও রচিত ইংরেজি ও সংস্কৃত ব্যাকরণের আদলে। ১৭৪৩ সালে প্রথম বাংলা ভাষার ব্যাকরণ রচয়িতা ম্যানুয়েল দ্যা অ্যাসুম্পসাঁও তাঁর ব্যাকরণ গ্রন্থ Vocabolario em idioma Bengalla, e Portuguez dividido em duas partes রচনা করেছিলেন পর্তুগীজ ভাষায়। পরবর্তীতে এন বি হ্যালহেড ইংরেজি ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ (A Grammar of the Bengal Language) রচনা করেন। আমাদের চিঠিপত্র ও অন্যান্য ব্যাকরণিক বিষয়েও ইংরেজি ব্যাকরণের যথেষ্ট ছাপ খুঁজে পাওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় আমরা এখন যে পদ্ধতিতে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক পত্র লিখি তা আমেরিকান ইংরেজির নিয়ম।

অন্যদিকে আমাদের বাংলা ভাষার প্রায় ১লাখ ২৫ হাজার শব্দের মধ্যে প্রায় ৪৪% হলো তৎসম, .৫৫% বিদেশী, ৫১% হলো দেশী ও অতৎসম শব্দ। বেশীরভাগ সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি ইত্যাদি থেকে গৃহীত। কিছু কিছু ইংরেজি শব্দ পরিবর্তিত উচ্চারণেও গৃহীত হয়েছে। আবার অনেক শব্দের প্রাসঙ্গিক শ্রুতিমধুর ভাষান্তর সম্ভব হয়নি বলে তা অবিকৃত অবস্থায় আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য শব্দে পরিণত হয়েছে। এগুলো উচ্চারণ না করে তার জায়গায় অপরিচিত, অপ্রচলিত, অপেক্ষাকৃত কম শ্রুতিমাধুর্য সম্পন্ন বাংলা শব্দ ব্যবহার করা একটু বেমানানই লাগে। তবে যেসব শব্দ বহুল ব্যবহৃত তাকে বাংলা অভিধান/শব্দ সম্ভারের অন্তর্ভূক্ত করে আপন করে নেওয়াই শ্রেয়।

একটি ভাষার সহজাত বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট সময় পর পর বদলে যাওয়া। তাই বলে এই না যে, অতিআধুনিকতা দেখাতে আমরা বাংলা ও ইংরেজির মিশ্রণ Stylish(!) বাংlish ভাষা ব্যবহার করব। তাহলে বাংলা ভাষা তার স্বাভাবিকতা হারাবে। আবার ইংরেজির প্রভাবমুক্ত করতে গিয়ে ইংরেজি পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়াও অবিবেচকের মত সিদ্ধান্ত নেওয়ার শামিল হবে। ফলে বাংলা ভাষা পৃথিবীর গতিময় পদযাত্রার সঙ্গে তাল না মেলাতে পেরে অনেক বছর পিছিয়ে যাবে। তবে আমরা দুই ভাষার সমতা বিধানে যেটা করতে পারি তা হলো প্রতিটি বাক্য আমরা হয় ইংরেজিতে না হয় বাংলায় বলার চেষ্টা করতে পারি। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ইংরেজি না হয় বাংলা ব্যবহার করতে হবে, কোন কোনক্রমেই গুবলেট বাংlish নয়।

আমরা কখনোই ইংরজির প্রভাব সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হতে পারবো না। কারণ ইংরেজি ভাষাও ধোয়া তুলসী পাতা নয় তাতেও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, ল্যাটিন, ফরাসি, জার্মান ইত্যাদি ভাষার প্রত্যক্ষ প্রভাব বিদ্যমান। ২১শে ফেব্রুয়ারির দিন ইংরেজি শোনা, বলা, পড়া, লেখা চলবেই। কারণ February শব্দটিও ইংরেজি। তবে আমরা অবশ্যই যে সর্বক্ষেত্রেই মাতৃভাষাকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দেব। এটি ভালভাবে শিখে অন্যান্য ভাষায় দক্ষ হতে কোন বারণ নেই। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বহুভাষাবিদ ছিলেন বলে তাকে কেউ বাংলা ভাষার প্রতি হুমকিস্বরূপ মনে করেন নি। তাই আমি বাংলা ও English-এর দ্বন্দপূর্ণ সম্পর্ক দেখতে চাই না চাই একটি সমান্তরাল গতিশীলতা। তাই এখন ইচ্ছা হলে শিরোনামটি পাল্টে ‘বাংলা & English’ পড়তে পারেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন