আমাদের এলাকার অধিবাসীদের মধ্যে উপজেলার নামের বানান
ঈ-কার দিয়ে বহুল পরিচিত হলেও ইদানীং তা ই-কার
সহযোগে লেখার প্রচেষ্টাও পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে
বাড়ছে দ্বিধা। তবে এই যে সংস্কার ও সনাতন, এর মাঝে কোনটি ঠিক তা একটি বিতর্কিত ও আপেক্ষিক বিষয়। তবে
বিভিন্ন সংগঠন ও গোষ্ঠীর সাথে কাজ করতে গিয়ে দুটি বানান ব্যবহার করা একটি স্ববিরোধের
পর্যায়ে পড়ে। তাই একজন যুক্তিবাদী সচেতন নাগরিক হিসেবে
কোন রকম ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত না দিয়ে আমি দুটি প্রস্তাবনার পক্ষে শুধু যুক্তি উপস্থাপন
করছি। আমার মত স্ববিরোধিতার অস্বস্তি কাটাতে
চাইলে বাকী দায়িত্ব আপনার।
ঈ-কার ব্যবহারের পক্ষে যুক্তিঃ
১। ভাষাকে
সুবিধাজনক করতে গিয়ে খুব দ্রুত বানান পরিবর্তন করলে দুই প্রজন্মের চিন্তার পার্থক্যের
মত বানান পার্থক্যও খুবই বেশি হবে। তাই
পরিবর্তন করা এক্ষেত্রে অনুচিত।
২। বানানের
ফলে উচ্চারণ পার্থক্য হয় না। কেননা, ‘মন’ শব্দটির বানান দেখে উচ্চারণ ম ও ন-এর স্বাধীনভাবে ব্যবহার হলে যেরকম উচ্চারণ হয় তা করে না। বরং
উচ্চারণ করে ‘মোন্’। তাই
অন্য বানান গুরুত্বহীন।
৩। আগের
বানান ঠিক রাখার ক্ষেত্রে জনসমর্থন অনেক বেশি। তাই
গণতান্ত্রিক মতবাদের ভিত্তিতে বানানটি অপরিবর্তিত থাকা দরকার।
৪। বেশিরভাগ
মানুষের কাছেই আগের বানানটি ব্যবহার একটি কমফোর্ট জোন হিসেবে বিবেচ্য। তাই
এটিই থাকুক। এতে বানান ভুল হবার সম্ভাবনাও কমবে।
৫। প্রায়
সবাই আগের বানানটিতে অভ্যস্ত। তাই
অপ্রচলিত অনভ্যস্ততাকে সরিয়ে রাখাই ভালো।
ই-কারের পক্ষে যুক্তিঃ
১। ভাষা মানুষের জন্য, মানুষ ভাষার জন্য নয়। তাই
মানুষের সুবিধার জন্য ভাষাকে পরিবর্তিত হতে হবে।
২। উচ্চারণ ঠিক রাখতেই বানানের উদ্ভব। তাই যদি না হতো তাহলে বিশ্বের সকল হরফের উচ্চারণ নির্দিষ্ট করতে IPA বা International Phonetic Alphabet প্রবর্তন
করার প্রয়োজন পড়তো না। এজন্য একই রকম উচ্চারণকে সংরক্ষণ
করতে ভিন্ন বানান অপ্রাসঙ্গিক।
৩। নতুন বানানের প্রতি জনসমর্থন কম
হলেও সমর্থনকারীরা প্রগতিশীল শ্রেণির প্রতিনিধি। এক্ষেত্রে মনে রাখা
দরকার সতীদাহ প্রথা নিবারণের লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের কাছে করা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের
আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করা ব্যক্তির চেয়ে প্রথাটি চালু রাখার ব্যাপারে করা রাজা রাধাকান্ত
দেবের আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করা লোকের সংখ্যা ছিল ঢের বেশি। কিন্তু আমার মত অত্যল্প
ইতিহাস জানা লোকও জানেন যে, ‘প্রগতিশীল ব্যক্তির
সংখ্যা সমাজে কম’ এ বিবেচনায় জয়ী হয়েছিল কম জনসমর্থিত প্রস্তাবটি।
৪। সংস্কৃত ভাষায় ঈ বর্ণটির উচ্চারণ
ই-এর চেয়ে দীর্ঘতর। কিন্তু বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণদুটির উচ্চারণ অভিন্ন। তাই বর্ণমালায় ৭টি মৌলিক
স্বরধ্বনি জ্ঞাপক ৭টি মৌলিক স্বরবর্ণ রাখাটাই উত্তম। যদিও অ্যা ধ্বনিজ্ঞাপক
কোন স্বরবর্ণ বাংলা বর্ণমালায় নেই। উপরন্তু একই উচ্চারণের জন্য ই, ঈ এবং উ, ঊ অর্থাৎ দুটি করে স্বরধ্বনি এবং
ঐ, ঔ ইত্যাদি যৌগিক স্বরধ্বনি বিদ্যমান। যেখানে উচ্চারণ বা শ্বাসাঘাত নির্ভর আরবি, স্প্যানিশ বা জার্মান ভাষায় একাধিক উচ্চারণ
নির্দেশের জন্যও একই বর্ণের উপর ফোঁটা বা দাগ ব্যবহার করা হয়। তাই বর্ণমালাকে অহেতুক
ভার বহনের হাত থেকে মুক্ত করতে একটি ধ্বনির জন্য যেকোন একটি এবং অ্যা ধ্বনির জন্য একটি
নতুন (সম্ভব হলে) বর্ণ নিশ্চিত
করা উচিৎ। আর এটি করতে গেলে বাদ দেওয়া বর্ণটির ব্যবহার আগে লোপ
করতেই হবে। তাতে বানান ভুলের সংখ্যাও কমবে।
৫। বাংলা ভাষার অভিভাবকসম প্রতিষ্ঠান বাংলা
একাডেমির প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম পরিমার্জিত সংস্করণ ২০১২ (পুনর্মুদ্রণ
২০১৫)-এর অতৎসম শব্দ অংশের ২.১ নিয়ম অনুযায়ী আমাদের উপজেলার
নামের
বানান ই-কার দিয়ে লেখাই
যুক্তিযুক্ত। যেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান নীতি প্রনয়ণের পর স্বয়ং
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেদের অভ্যস্ততা ভেঙ্গে অভিন্ন
নিয়মে বানান লিখেছেন সেখানে আমাদেরও তা মানতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।
ভাষা নিয়ে প্রচণ্ড
বিরোধিতাপূর্ণ মতামতের সংঘর্ষের কথা উঠলেই আমার মনে আসে বাংলা সাহিত্যের দুই
দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রমথ চৌধুরীর সাধু-চলিত দ্বন্দ্বের কথা।
রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন সুস্থিত সাধুই হবে কথ্য ভাষার মানদণ্ড, সেখানে
অপরিবর্তনশীলতার কারণে বিলুপ্ত হওয়া এককালে শক্তিশালী ভাষা সংস্কৃত ও ল্যাটিনের
উদাহরণ টেনে প্রমথ চৌধুরী পক্ষ নিয়েছেন চলিত ভাষার। শুধু ভাষা সংক্রান্ত
চিন্তাধারার বৈপরিত্যের জন্য একে অপরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছিলেন এ দুই
আত্মীয়। তবে কালের পরিক্রমায় প্রাকৃত যেমন টেক্কা মেরেছিল সংস্কৃতকে, ঠিক তেমনি
সাধু ভাষাকে হটিয়ে চলিত ভাষা অধিকার করে নিয়েছিল লেখ্য ও কথ্য উভয় ভাষার দখল। তবে
বিংশ শতাব্দীর চলিত বুলেট ট্রেন গতির এ পরিবর্তনশীল যুগে কতটা মানানসই সেটাও
বর্তমানে খতিয়ে দেখার বিষয়। আর উপরের সমগুরুত্ব ও সমসংখ্যক যুক্তির ভিত্তিতেও যারা
কোন পক্ষ বাছাই করার ক্ষেত্রে আমার মত সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন, তারা দয়া করে দেরি
করুন এবং দেখুন সময় কাকে বাছাই করে নেয়!
শামীম আল
মাহমুদ (শিমুল)
প্রতিষ্ঠাতা
সদস্য
অভয়ারণ্য
(Sanctuary)
Good writing but more theoretical. You smartly made a confusion on people's mind.
উত্তরমুছুন