ইংরেজী সাহিত্যের কবি টিএস ইলিয়ট লিখেছিলেন `April is the cruelest month’। তিনি যদি বাঙালি হতেন তাহলে হয়ত আবার লিখতেন- August is the cruelest month। এই বাংলায় ডেড ল্যান্ড নেই, সেই লাইলাক ফুলও ফুটে না। তবে ফুলের মতো সৌন্দর্য আর সৌরভ বিলানো মানুষেরা অকালমৃত হয়ে ঝরে পড়ে বাংলার উর্বর ভূমি থেকে এই আগস্ট মাসে।
এই বাংলায় রবীন্দ্রনাথ-নজরুলরা যেমন প্রতিদিন জন্মায় না, তেমনি হাজার হাজার বছরে মাত্র একবারই জন্মায় ক্ষুদিরাম-নেতাজি-বঙ্গবন্ধু-তারেক মাসুদেরা। আর বাঙালিদের কাঁদিয়ে আগস্টেই চলে গেছেন তাঁরা! কেমন যেন আগস্ট আসলেই শোকের বারতায় ভরে যায় ক্যালেন্ডারের পাতা, হিসেবের খাতা।
রবিহারা আগস্ট
ছবি: ইন্টারনেট
এই আগস্টেই ঝরে গেছেন বাংলার আকাশের প্রতিদিনের সূর্য রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনে দীর্ঘদিন প্রোস্টেট ক্যান্সারে ভুগে রোগশয্যায় ছিলেন। তারপর ১৯৪১ সালে তাঁকে কলকাতার পৈত্রিক বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। বাংলার আকাশের প্রতিদিনের সূর্য ডুবে গেলেন এই আগস্টেই।‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’
সময়টা ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ভোর পাঁচটা। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়ালেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম। কারাফটকের বাইরে তখন হাজারো জনতার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে ‘বন্দেমাতরম’স্লোগান। কারা কর্তৃপক্ষ যুবকটির কাছে জানতে চাইল, মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ ইচ্ছা কী?
ছবি: ইন্টারনেট
ক্ষুদিরাম নিঃশঙ্কচিত্তে বলে উঠলেন, ‘আমি ভালো বোমা বানাতে পারি, মৃত্যুর আগে সারা ভারতবাসীকে সেটা শিখিয়ে দিয়ে যেতে চাই।’ তারপর ফাঁসির মঞ্চে ঝুলে গেলেন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ক্ষুদিরাম। সেই সাথে এই আগস্ট মাসেই বাংলার আকাশ থেকে একটা বিপ্লবী তারা খসে গেলো।ঝরা কাগজের ফুল সেলুলয়েডের কারিগর
যে ‘কাগজের ফুল’ তিনি সেলুলয়েডের পর্দায় ফোঁটাতে চেয়েছিলেন সেই ফুলটা প্রস্ফুটত হওয়ার আগেই পাবনার ইছামতী নদীর তীরে থেকে ফেরার পথে ঝরে যায় আজকের এই দিনে।
ছবি: ইন্টারনেট
সময়টা মধ্য দুপুর, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক। হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে একটি বাস এসে মাইক্রোবাসটির উপর চালিয়ে দেয়। রক্তলাল পাপড়ি দুটো(তারেক মাসুদ-মিশুক মনির) মুহুর্তেই ঝরে পড়ে। এই আগস্টেই জাতি হারায় তার আরও দুই শ্রেষ্ঠ সন্তান।শোকাবহ আগস্ট
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোরের আজানের ধ্বনির পর পরই ক্রসফায়ারের মুহুর্মুহু শব্দে কেঁপে উঠলো ধানমণ্ডির ৩২ নাম্বার বাড়ী।
মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর ডালিমের নেতৃত্বে মেজর নূর, হুদা, মহিউদ্দিন সহ আর কিছু বিপথগামী সৈন্যরা আক্রমণ করলো বঙ্গবন্ধুর বাড়ী।
সময়টা ভোর ৫টা ৪০ মিনিট। বঙ্গবন্ধু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসবেন ঠিক তখনই দ্বিতীয় তলায় তাকে পেলেন মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিন আমতা আমতা করে বললো, ‘স্যার, আপনি আসুন’।
বঙ্গবন্ধু কর্কশ ভাষায় বললেন, ‘তোমরা কী চাও? তোমরা কী আমাকে খুন করতে চাও? ভুলে যাও। পাকিস্তানী বাহিনী তা করতে পারেনি, তোমরা কী মনে করো তোমরা তা করতে পারবে?’
ছবি: ইন্টারনেট
ঠিক তখনই মেজর নূর এসে হাজির। মহিউদ্দিনকে সরিয়ে দিয়ে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই নূর চিৎকার করে ব্রাশ ফায়ার চালালো বঙ্গবন্ধুর বুকে। সঙ্গে সঙ্গে স্টেনগানের গুলি বঙ্গবন্ধুকে ভেদ করে দেয়ালে গিয়ে লাগলো। নিথর দেহটা সিঁড়ির মধ্যে পড়ে রইলো। রক্তে ভেসে গেলো পুরো সিঁড়ি, মুজিবের সাদা পাঞ্জাবি আর ধুসর বর্ণের লুঙ্গি। আর ডান হাতে ধুমপানের পাইপটা থাকলেও বাঙলার আকাশে ভোরের সূর্য উঠার আগেই ‘রাজনীতির কবি’র জীবন প্রদীপ নিভে গেলো। সেই সাথে আগস্ট মাস বাঙালির কাছে হয়ে গেলো শোকাবহ আগস্ট।নেতাজির অন্তর্ধানের আগস্ট
"তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব" এই উক্তির প্রণেতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু।
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র পরপর দুইবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত দ্বন্দ্বের জেরে তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। নেতাজি সুভাষচন্দ্রই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন। কারারুদ্ধ করে ভারত থেকে নির্বাসিত করা হয়। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে ভারতে ফিরে এলে আবার তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। এভাবে তিনি ১১ বার কারারুদ্ধ হন।
ছবি: ইন্টারনেট
দেশে বিপুল জনসমর্থন গড়ে উঠে নেতাজির। তার বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী একটা চক্র কাজ করতে থাকে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইওয়ানের তাইহোকুতে একটি বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। তবে তাঁর এই মৃত্যু নিয়ে আজও বিতর্ক রয়ে গেছে। বিতর্ক থাকলেও আগস্ট মাসেই বাঙালি হারায় তার আরেক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে।মহাবিদ্রোহীর মহাপ্রয়াণ
নজরুল বেঁচে থাকতে পেয়েছেন উপেক্ষা আর মৃত্যুর পর পেয়েছেন সম্মান। আমাদের বিদ্রোহী কবি নজরুলের ক্ষেত্রে হুমায়ুন আজাদের একটা উক্তি বেশ প্রযোজ্য- “বাঙালি মুসলমান জীবিত প্রতিভাকে লাশে পরিনত করে, আর মৃত প্রতিভার কবরে আগরবাতি জ্বালে।” নজরুলের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। অসুস্থ নজরুল তার প্রাপ্য সেবা-চিকিৎসা পাননি। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে ধুকে ধুকে জীবনের শেষ দিনগুলো পার করেন।
নজরুল যখন মৃত্যু পথযাত্রী তখন তাকে তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশে এনে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয়। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুলকে ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে দেয়া হয় একুশে পদক।
ছবি: ইন্টারনেট
বিদ্রোহীর জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মহাবিদ্রোহী রণে ক্লান্ত হয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে। এক কবিতায় তিনি এই অন্তিম ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন, “মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই/যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।” এই আগস্টেই বাংলা সাহিত্যের আরেক দিকপাল হারিয়ে যায়।
বাংলার তারকা-মহাতারকারা এই নিষ্ঠুর আগস্টেই বাংলার মহাকাশ থেকে থেকে ঝরে গেছেন। তাই বাঙালির জীবনে আগস্ট শোকের মাস, বেদনার মাস। এদেশের বুকে যেন এমন শোকাবহ আগস্ট আর না আসে এটাই বাঙালির প্রত্যাশা।শরীফ আহমেদ
সাব-এডিটর
নিউজলাইনবিডি.কম
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন