বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৫

বৈতালিক বিদায়

হে গানের পাখি, আজ তোমায় ডাকি, যেও না আমাদের ছেড়ে
আমাদের সব ভালবাসা অর্পিত আজ তোমার দোরে।
তুমি দখল করেছ স্থায়ী আসন আমাদের ওষ্ঠাগত প্রাণে
আমরা অসহায়, শান্ত, সান্ত্বনা পেতাম তোমার বজ্রগানে।

আজ শুনি না রোজ সকালে তোমার তেজস্বী অশ্বহ্রেষা
যা সাধারণ মনে হত শুনতাম বলে হর হামেশা।
মোরা হামাগুড়ি দেই আজো তাই বুঝিনি তোমার কদর
তুমি দ্বিধাহীন মহামতি তোমার বুনিয়াদ যেন মর্মর।
তোমায় চিনিনি সঠিক সময়ে তাই দিতে হচ্ছে মাশুল
তোমার কারখানা থেমে গেলেও অম্লান তুমি হিরন্ময় বুলবুল।

তোমার অভীষ্ট লক্ষ্যে চলা কেউ করতে পারে নি রদ
হতবাক আমরা দেখে মহাযাত্রার পথে তোমার পদ।
তোমার প্রয়াণে আজ নেমেছে ঘোর কৃষ্ণপক্ষ
তুমি ব্যতীত মোদের কাছে পরাজিত হবে কি যক্ষ?
ভাবতেই খারাপ লাগে শুনবো না আর তোমার সুর মূর্ছনা
তবু যেখানেই থাক ভাল থেকো এটুকুই শেষ কামনা।

শনিবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৫

বঙ্গবন্ধু: ব্যক্তিক সীমানা ছাড়িয়ে প্রতিষ্ঠান

প্রতি শতাব্দীতেই কিছু কিছু মানুষ আবির্ভূত হন যারা স্থান কাল পাত্রের গণ্ডি পেরিয়ে সারা বিশ্বের সম্পদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এদের মধ্যে একজন চে। যারা ফুটবলে আর্জেন্টিনা সমর্থন করেন তারা অনেকেই জানেন না যে এর্নেস্টো চে গেভারা দে লা সের্না (১৪ জুন ১৯২৮ অক্টোবর ১৯৬৭)-এর জন্মভূমি আর্জেন্টিনা। কিন্তু তারা জানুন বা না জানুন চে কিন্তু সুদূর ল্যাটিন আমেরিকা ছেড়ে ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়াই মৃত্যুর পরও আমার আপনার দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল আমরা আমাদের জাতীয় নায়কদের না চিনে বিদেশীদের নিয়ে মাতামাতি বেশিই করি। এ জন্যই বলা হয় বাঙালির ইতিহাস সচেতনতা নেই ফলে বাঙালি মানুষ হচ্ছে না। আমরা আজ যাকে বাংলাদেশ বলছি তার নামকরণ করার জন্য জন্ম হয়েছিল এমন একজন যাদুকরী নেতার যিনি অনুসারীদের একচক্ষু দৃষ্টিভঙ্গির জন্য আজ বিশ্বমানের নেতা হয়েও কয়েকটি আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান, স্থাপত্য ভবনের নামে বন্দী অবস্থায় দলীয় বলয়ে আবদ্ধ হয়ে অসম্মানিত হচ্ছেন। তাঁকে আর নতুন করে পরিচিত করানোর কিছুই নেই, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৭ মার্চ ১৯২০ – ১৫ আগস্ট ১৯৭৫) তাঁকে নির্দেশ করতে কোন উপাধির প্রয়োজন হয় না, কেননা শেখ মুজিব মানেই বাংলাদেশ। আর রবি ঠাকুরের মত দেশ মাটিতে তৈরি নয়, দেশ মানুষে তৈরি। তাই কোন বাঙ্গালিকে যদি শেখ মুজিবুর রহমানকে চেনাতে দ্বিতীয় কোন কথা বলতে হয়, তবে তা হবে জাতির জন্য কলঙ্কজনক
বর্তমান পরিস্থিতিতেও বঙ্গবন্ধু আজও প্রাসঙ্গিক, তাঁর চিন্তাধারা আধুনিক ও সমসাময়িক। তাই তাঁকে নিয়ে প্রচুর চর্চা করা দরকার। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল তাঁকে নিয়ে লেখা বইগুলো এক শ্রেণির লোকের কাছে গ্রহণযোগ্যই নয়; এর পিছনে অবশ্য বাঙ্গালির অতি আবেগময়তার পরোক্ষ প্রভাবও আছে। তবে শেখ মুজিবের মাঝে ছিলেন একজন নেলসন ম্যান্ডেলাকেননা তিনিও ছিলেন অন্যায়ে আপোষহীন, স্বাধীনতার পথে তিনিও হেঁটেছেন দীর্ঘপথ, ভোগ করেছেন ১৪ বছরের কারাবাস। তবু তাঁর মধ্যে দেখা যায় স্থির সৌম্য এক গান্ধীর প্রতিচিত্র। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে তিনি বলেছেন, “আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালাইয়া যাইব”আবার মুক্ত স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর ১০ জানুয়ারির বক্তব্যে পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে তাঁর অভয় বাণী, “তোমরা আমার লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছ, মা-বোনদের ইজ্জত লুন্ঠন করেছ, অসংখ্য বাড়িঘর জ্বালিয়েছ এবং আমার কোটি কোটি মানুষকে তাড়িয়ে দিয়ে ভারতে যেতে বাধ্য করেছ। এরপরও আমি তোমাদের প্রতি কোনরূপ বিদ্বেষ পোষণ করি না।” অপরদিকে দেশ স্বাধীন হবার পর তাঁর বাণী, “আমি সাহায্য চাই কিন্তু স্বাধীনতা বিক্রি করে সাহায্য চাই না” এবং তাঁর ট্র্যাজিক মৃত্যু চের কথা মনে করিয়ে দেয়। অনেকের অনেক গুণাবলি তাঁর মাঝে সুষম অনুপাতে মিশে তাঁকে এক স্বতন্ত্র নেতায় পরিণত করেছিল। ফলে তিনি রাজনীতিতে সমাজতন্ত্রের পথ ধরে গণতন্ত্রে উপনীত হয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন ধর্ম নিরপেক্ষতার যা আজও অর্জন করতে আমরা ব্যর্থ। মানুষের ভালবাসাই ছিল তাঁর বড় শক্তি। তিনি মানুষকে অন্ধভাবে ভালবাসতে পারতেন। ৭ মার্চের ভাষণে দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেন, “আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের মুক্তি চাই” এ কথার সত্যতা হিসেবে রাজনৈতিক কূটচালের স্বীকার হয়ে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দলের সাধারণ সম্পাদক পদ আঁকড়ে ধরার ইতিহাস তাঁর আছে। ’৭০ এর নির্বাচনের আগ মুহূর্তে নির্বাচনী প্রচারণা ছেড়ে মানবতার ডাকে সামুদ্রিক ঝড় গোর্কি আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা গেছে তাঁকে। যেখানে ১০ লাখ লোক নিহত হলেও পশ্চিম পাকিস্তানের কোন দৃষ্টিপাত ছিল না। লায়ালপুর সামরিক কারাগারে তাঁর সেলের সামনেই যখন তাঁর নিজের কবর খোঁড়া হচ্ছিল তখনও তিনি পরিবার পরিজন ছেড়ে দেশের কথা ভাবছিলেন। তিনি মৃত্যুদন্ড শুনেও খুশি ছিলেন কেননা তিনি ভেবেছিলেন তাঁর কবরের উপর দিয়েই আসবে বাংলার স্বাধীনতা। তিনি শুধু চেয়েছিলেন তাঁর মৃতদেহ যেন জনগণকে দেয়া হয়। এত ভালবাসার বিনিময়ে ভালবাসাও জনগণের পক্ষ থেকে তিনি কম পান নি। তাই তো যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর তিনি সর্বকনিষ্ঠ মন্ত্রী হিসেবে সমবায় ও কৃষিঋণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। এমনকি, পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা নাসের, যাকে বঙ্গবন্ধুকে বৈকালিক ভ্রমণে হাঁটার সময় গুলি করে মেরে পালানোর চেষ্টায় মৃত্যু গুজব ছড়ানোর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল সেও পাকিস্তান সরকারের নোংরা কৌশল বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করে তার নিজের জীবন উৎসর্গ করে।
বঙ্গবন্ধুর বহুমুখিতা এতই বেশি যে তিনি নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান তাঁকে নিয়ে আজও সঠিকভাবে নতুন প্রজন্মের সাধারণ মানুষের জানার সুযোগ কম। যে শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্টের শিক্ষা ও বাণিজ্য মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ১৯৫৮ সালে ইস্ট পাকিস্তান ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেখান থেকে তাঁর জীবনী নিয়ে কোন ঐতিহাসিক চলচ্চিত্র বা তথ্যচিত্র করা হয়েছে কিনা সেটি একটি খতিয়ে দেখার বিষয় এছাড়াও তাঁর জীবনী আবেগের মেদ ছাড়া বস্তুনিষ্ঠ নিরপেক্ষভাবে লেখা নেই বললেই চলে। আমরা আজও তাঁর প্রেমিক জীবন, রাজনীতির প্রথম দিককার সাম্যবা, প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষতা, তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক ভাবনা, বৈশ্বিক কো-এক্সিসটেন্স সম্পর্কে কতটুকু জানি? আন্তর্জাতিক সাংবাদিক লোরেন জেঙ্কিন্স যাঁকে Poet of Politics বলেছেন, BBC বাংলা সার্ভিসের শ্রোতা জরিপ যাকে সর্বকালের সর্বসেরা বাঙালির স্বীকৃতি দিয়েছে তাঁর সম্পর্কে ভাসা ভাসা কিছু তথ্য জেনেই স্লোগান ধরাটা আমার কাছে খাপছাড়া মনে হয়। তাই সময় এসেছে শেখ মুজিবের জীবনের অতল গভীরতায় ডুবে পরোক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মাধ্যমে তাঁকে অন্তরে ধারণ করার। কেননা তিনি নিজেও করে শেখার পক্ষপাতী ছিলেন। অনেকে এখনো মুজিব হতে চায় কিন্তু স্বার্থচিন্তায় বা ভয়ে সঠিক কথা বলতে পারে না। নতুন ভাবে মুজিব চর্চা হয়তো সমাজ পরিবর্তনের এই সৃজনশীল অগ্রদূত মুক্তচিন্তানায়কদের মৃত্যুভয়ের সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করতে পারে চিরতরে।

গ্রন্থপঞ্জিঃ
1.    অসমাপ্ত আত্মজীবনী
2.    বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- মনি হায়দার
3.    জাতির জনক বঙ্গবন্ধু- শাহজাহান কিবরিয়া
4.    কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, আগস্ট ২০১৫

শনিবার, ১১ জুলাই, ২০১৫

চাঁদে পা রাখা

না, আমরা সত্যি সত্যি রকেটে করে মুক্তিবেগে পৃথিবী ছেড়ে চাঁদে যাইনি এমনকি আফ্রিকার দেশ চাদেও যাইনি; আমরা গিয়েছিলাম চাঁদপুর। তবে আমরা নীল আর্মস্ট্রং বা চাদ/শাদের রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ে কম আনন্দ পাইনি এটা বলাই বাহুল্য
কয়েকদিন থেকেই মনে বাজছিল হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোথাও। ১২ মে ক্লাস করে রুমে এসে দেখি জাকিয়ার ফোন। ও প্রান্ত থেকে নির্দেশ এলো হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কয়েকজন মিলে বিকেলে চাঁদপুর যাবে, আমাকেও যেতে হবে। সঙ্গী হিসেবে আছে রাহুল, আঁখি, মামুন, সুপ্তি ও জাকিয়া। তাই ভাবলাম জুটিতে কাবাবের হাড্ডি হয়ে যাওয়ার চেয়ে কথা বলার জন্য সঙ্গী মুজাহিদকে নিয়ে যাই। যেই কথা সেই কাজ, মুজাহিদকে ফোন দিলাম। কিন্তু সম্ভবত ওর বয়সজনিত দুর্বলতা বিকেলে না যাওয়ার পক্ষে রায় দিল। আমিও আবেশ প্রক্রিয়ায় না বলে দিলাম। পরে ওরা আবার ফোন দিয়ে জানাল যে যাত্রা শুরু রাতে। আমিও আবার মুজাহিদকে নক করলাম। ও বলল ঠিক আছে। আমিও তাই সম্মতি দিলাম। রাতে সব কাপড় চোপড় গুছিয়ে বের হওয়ার সময় শুনি মুজা বেঁকে বসেছে। ওর আবার সকালে যে যুক্তি দেবে রাতে তা খন্ডানোর বিরল বদ অভ্যাস আছে। আমি সহযাত্রীদের জানিয়ে দিলাম আমি যাচ্ছি না। কিন্তু মানুষ ঈশ্বরের কথা না শুনলেও নারীদের কথা ঠিকই শোনে। তাই জাকিয়ার ফোনে মুজা রাজি হয়ে গেল। ফলে রাত ১০টার দিকে জগন্নাথ হলের সাক্ষাৎপ্রার্থীদের কক্ষ থেকে রিক্সাযোগে সদরঘাট রওনা দিলাম। নামার পর রিক্সাওয়ালা নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে বেশি নিল। প্রলিটারিয়েটদের অধিকার তো আর ক্ষুণ্ন করা যায় না! দরকারি জিনিস কিনে টিকেট কেটে ভিতরে ঢুকলাম। আমি আগে জানতাম যে ঐতিহাসিক দর্শনীয় জায়গায় যেতে টিকেট কাটতে হয়। কিন্তু এখানে এসে আমার ভুল ভাঙ্গল। আর ঢুকেই মনে পড়ে গেল বহুল চর্চিত প্রবাদ ‘বাইরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট’কিন্তু আমাদের কয়েকজন ঢুকেই ছবি তোলা শুরু করল। হায়রে ফেইসবুক, সবাইরকে মডেল করেই ছাড়ল!
সাগর পেরোলে নাকি জাত যায়। আমার এই প্রথম লঞ্চ ভ্রমণেও সে আশঙ্কা ছিল। কিন্তু দুঃখী জাত গিয়ে যদি সুখী জাতিতে পরিবর্তিই হলে মনে হয় মন্দ হত না। তবে কষ্টের উপাদানকে মুজার কথা মত ঢাকায়ই রেখে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। রফ রফ লঞ্চে উঠেই একটি বিচ্ছিন্ন অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটল। তারপর আমাদের আপাত-স্থায়ী ঠিকানা হল ২৩১ ও ৩২৩ নং কেবিন। দ্বিতীয়টি ছিল তিন তলায় আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এই ভ্রমণটি কারো জন্য ছিল অভিযান আর কারো জন্য অভিসার। বলতেই হয় না আমি ১ম দলেরই লোক। তাই লঞ্চের রেলিং ধরে উচ্চ স্বরে গান গেয়ে, এসি রুমে তাস খেলে সময় পার করলাম। আমার জীবনের বিনিদ্র রজনীর আর্কাইভে জায়গা করে নিল আরেকটি রাত। ভোরের দিকে একটু চোখ বুজে ঘুমের ভান করলাম যেটা আবার মুজার মতে রোমান্টিক ঘুম নাম নিল।
ইচলীতে নামলাম সকালে। নেমেই সেখান থেকে সিএনজি করে গেলাম নীল কুঠিবাড়ীতে। কুঠিবাড়ী থেকে ফিরে ডাকাতিয়া নদীর উপর ব্রিজের পাশে নেমে নাস্তা করলাম। তারপর চীনা বাড়ীর পাশ দিয়ে গেলাম নৌকা ঘাটে। সেখান থেকে নৌকা করে তিন নদীর মোহনায় গেলাম। পিচ্ছিল কংক্রিটে পিছলে গিয়ে রক্তাক্ত হল মামুন। তবে জায়গাটা অনিন্দ্য সুন্দর। বাতাস আর পানির এক অপূর্ব মিথষ্ক্রিয়া আমাকে মাতিয়ে দিল।
এরপর আবার ইঞ্জিনচালিত নৌকায় গেলাম চরে। চরে চরছিল একটি গরু। তার সাথে ছবি তুলল মুজাহিদ ও মামুন। চরে ল্যান্ড করেই আমরা ক্ষান্ত হলাম না আমদের তাড়নে জলও আন্দোলিত হল প্রবলভাবে। এখানে কয়েকজন গোসল করলাম নদীতে আর অনেক দিন পর সাঁতার কাটার সুযোগ পেলাম। গোসল সেরে আবার ইঞ্জিনচালিত নৌকাটিতে উঠলাম। এবার গন্তব্য ইচলী ঘাট। ভেজা কাপড়গুলো সবাই শুকাতে দিয়েছিল নৌকার উপর। কিন্তু জায়গা সংকটের জন্য আমি আমার র‍্যাগ ডের পোলো শার্টটি শুকাতে দিয়েছিলাম নৌকার ছাউনিতে। বায়ুর দেবতা রুষ্ট হলেন। তাই প্রচন্ড বাতাসে আমার র‍্যাগ ডের পোলো শার্টটি উড়ে গেল মাঝ নদীতে। আমি আর তোলার কোন উদ্যোগও নিলাম না। যাক র‍্যাগ সংক্রান্ত সকল স্মৃতি মুছে যাক। র‍্যাগ ডের প্রথম দিন ভাঙ্গল আমার রোদচশমা এরপর দ্বিতীয় দিন ছিঁড়ে গেল ঘড়ির বেল্ট। আর তার চেয়ে বড় কষ্ট র‍্যাগ ডে শেষ হওয়ার পর আমি হারালাম সুখী হওয়ার কারণ। তাই র‍্যাগ ডে সম্পর্কিত সবকিছু হারিয়েই যাক না হলে কষ্টগুলো নবায়ন হয় অনেক গুণে।

ফেরার সময় রাত জেগে সারাদিনের ক্লান্তি আমার শরীরে জেঁকে বসল। তার সাথে দূর হয়ে গেল নতুন কিছু অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের উত্তেজনা। ফলে ডেকে শরণার্থীর মত শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। তখন বুঝলাম খাইরুল স্যারের ক্লাসে পড়া গ্লোবালাইজেশনের মাহাত্যবিশ্বায়ন সব দেশকে একই জাহাজে তোলে কিন্তু কাউকে কেবিনে রাখে আর কাউকে ডেকে। আমার প্রথম লঞ্চ ভ্রমণ আমার এই দুই অভিজ্ঞতার তুলনামূলক বিশ্লেষণের সুযোগ করে দিল। তবে সব মিলিয়ে সময়টা খারাপ কাটল এটা বলা বোধ করি ঠিক হবে না।

রবিবার, ২১ জুন, ২০১৫

জনক-জননীর জন্য



১০ মাস ১০ দিন কষ্ট সীমাহীন, সহ্য করে সব করল প্রসব
তাদের চেয়ে নয়তো আপন কোন মানবী কিংবা মানব
অজস্র ত্যাগ তিতীক্ষায় করল লালনপালন, সবাই জানি
স্রষ্টার পরই তারা পূজনীয় স্নেহের আধার জনক-জননী

মা বাবার মাধ্যমে জগতে সবার আগমন
তাঁদের কাছে সন্তান নিজের জীবনের চেয়ে বড় ধন
সন্তানের প্রতি পিতা মাতার ভালবাসা সীমাহীন
তারাদের ঔজ্জ্বল্যও হবে ম্লা তবু ভালবাসা রবে অমলিন
তাদের মাধ্যমেই পেলাম নীতি আর গুণের শিক্ষা
বিধাতার কাছে তাদের সুস্বাস্থ্য, সৌভাগ্য চাই ভিক্ষা

শনিবার, ৯ মে, ২০১৫

আমার পূর্বসূরি

আমার মত বাজে চেহারার ও শীর্ণকায় ছেলেকেও যে কেউ ভালবাসতে পারে তা আমার মা-বাবাকে না দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। তার অবশ্য একটা কারণ আছে। আমার আগে আমার মাকে দুইজন মৃত সন্তানের মুখ দেখতে হয়। আমি ছিলাম ৭ মাসের প্রিম্যাচিউরড ছেলে সন্তান। ভূমিষ্ঠ হবার পরও আমার ফুসফুসের কার্যকারিতা শুরু হয়নি। অর্থাৎ সবার মতে জন্মানোর সাথে সাথেই আমি কান্নাকাটি করিনি। সবাই ভেবেছিল আমিও আগের দুই ভাইয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছি। কিন্তু আমার দাদীর চড়-থাপ্পড় আমাকে কাঁদতে বাধ্য করে। সেই কান্নাই সবার মুখে হাসি ফুটিয়েছিল।
আমরা ৩ ভাই-বোন। বড় বোন শাহনাজ পারভীন (২০ জানুয়ারী ১৯৮৫-?)-এর সাথে রক্তের কোন সম্বন্ধ না থাকলেও তার সাথে সম্পর্কটা আরো বেশি। আমার খালুর মৃত্যুর পর বাবা তার কন্যা প্রীতি থেকে খালার ৩য় ও ছোট মেয়েকে দেখাশোনার ভার নেন। তারপরই আমি। আমি রূপে কখনোই আকর্ষণীয় না তার মধ্য আবার আমার জিভ বিদ্যুতের মত তাই দাদা ও নানা উভয় দিকের আত্মীয়রা বলেন আমি নাকি অপর বংশের গুণ নিয়ে জন্মেছি। আমার ছোট ভাই সাব্বির আল মাহমুদ (৫ জুন ১৯৯৬-?)। ওর কথা মনে হলেই আমার আলেক্সান্ডার দ্যুমার ‘দ্য কর্সিকান ব্রাদার্স’-এর কথা মনে হয়। তার সাথে আমার মিল খুবই কম। তাই সবাই তাকে নিজেদের গুণাবলি সম্বলিত বলে। আমাদের বাবা-মার বিবাহ বার্ষিকী ৬ জানুয়ারী ১৯৮৭। আমার বাবার নাম মোঃ দেলোয়ার হোসেন (১ নভেম্বর ১৯৫৮-?)। এক কথায় কাদা মাটির মানুষ। আমার দাদার নাম বাজেতুল্লাহ মুন্সী দাদী সখিনা বিবি। শিক্ষানুরাগী দাদা আমাকে খুব পছন্দ করতেন কারণ আমি নাকি তার মত চেহারার ছিলাম। কিন্তু আমি যখন খুব ছোট তখনই তিনি মারা যান। ফলে বড় হয়ে আমি যে তাকে উচ্চতার দিক থেকে পরাজিত করছিলাম তা তার দেখা হয়নি। আমার বাবার দাদা শহর আকন্দ দাদী আয়াল বিবি। বাবার নানা হাজী তারিফুল্লাহ নানী খোশজান বিবি। আমার মায়ের নাম সুরাইয়া পারভীন (১৬ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২-?)। আমার নানার নাম হাজী তপসের আলী নানী মমিরন বেগম। মার দাদা নছর দেওয়ানী দাদী বুলি। মার নানা আজিতুল্লাহ সরকার নানী আয়মনা। আমার জ্ঞেয় পূর্বসূরির তালিকা এ পর্যন্তই। আর আমাদের পরিবারে উত্তরসূরিও আছে একজন, সে হল আমার বোনের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদাউস (১১ নভেম্বর ২০০২-?)।
আমার পরিবার আমার কাছে মন্দিরের মত। এখান থেকেই আমার প্রাক-প্রাথমিক তথা জীবনের সবচেয়ে কার্যকর শিক্ষাগুলো পেয়েছি। আমার চরিত্রের যা কিছু ভালো তার গোপন কুঠুরী আমার পরিবার। সুকুমারবৃত্তি ও বোধশক্তির অংশটা বাবার কাছ থেকে পাওয়া আর সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারটার জন্য আমি মায়ের কাছে ঋণী। এছাড়াও সময়ের চেয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার বড় বোনের অবদান অস্বীকার করলে আমি পাপী হব। ছোটবেলা থেকেই বাবার চাকরি ও কৃষিক্ষেত্রে অমানুষিক পরিশ্রম ও আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি ভালবাসা আমাকে অবাক করত। আমি দেখতাম তার কথাকে মূল্যায়ন করা হতো অন্য মাত্রায়। এমনকি বাজারে একবার ধান বিক্রি করতে নিয়ে যাওয়ার সময় এক পাইকার বাবার মুখে ধানের ওজন শুনে না মেপেই ধান কিনে নিয়েছিল। আমি তখন বলেছিলাম, ‘এরপর কম করে নিয়ে আসবে’। বাবা বলেছিলেন যে কথা ও কাজে অসামঞ্জস্য রাখতে হয় না। তারপর থেকেই আমিও তা কমবেশি মেনে চলি। আমার বাবা খুব ধার্মিক ও শিক্ষানুরাগী। আমার ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত আমার আনুষ্ঠানিক গৃহশিক্ষকও আমার বাবা। মনে আছে একটা সময় ‘গ্রন্থ বিপণী’ নামক লাইব্রেরীর সাথে চুক্তি ছিল যে আমি মাসে যা বই নেব বাবা মাস শেষে তা পরিশোধ করবেন। তবে অন্য কিছু না শুধু বই। আমার ৫ম শ্রেণিতে একটা ফুটবল কেনার শখ ছিল। কিন্তু বৃত্তির টাকা হাতে পেয়ে বই ছাড়া অন্য কিছু কেনা হয়নি। আর ফুটবল খেলাও অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছিল। পরবর্তীতেও যেকোন সাফল্যে আমি বই উপহার নিতাম।
আমি একেবারে ছোট বেলায় খুব মোটা আর রোগা ছিলাম। ফলে অবধারিতভাবেই আমাকে নিয়ে বাবা-মার বিভিন্ন জায়গায় দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে। আমি সকালে উঠতে পারি না বলে বাবা-মা দুজনেই জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকে আমাকে ডেকে দিতেন, এখনও দেন। তারা আমার বন্ধুত্বের সীমানা অর্থনীতি কিংবা লিঙ্গ দিয়ে বেধে দেননি। তারা আমাকে নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। তারা আমাকে শিক্ষা দিয়েছেন স্থান, কাল, পাত্র নির্বিশেষে মানুষকে ভালবাসতে। তবে আমি বুঝে না বুঝে তাদেরকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। ৫ম শ্রেণিতে আমার মারা যাওয়ার মত প্রচন্ড জলবসন্ত হয়েছিল। সময়টা ছিল বৈশাখ আর আমাদের বাসারও সংস্কার কাজ চলছিল। তখন এক ঝড়ের রাতে চলৎশক্তিহীন আমাকে নিয়ে চলছিল টানাটানি। বাবা এসময় সারারাত একটা খোলা টিনের চাল ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন যেন তা উড়ে না যায়। আমার উপর তাদের প্রচুর প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু প্রতিউত্তরে আমি তাদেরকে নিরাশ করেছি। প্রথমে ক্যাডেট হতে না পেরে পরবর্তীতে ডাক্তার হতে না পেরে। আমার বাবার খুব ইচ্ছা ছিল আমি মেডিক্যালে পড়ি। কিন্তু বলা চলে আমি ইচ্ছাকৃতভাবে সেদিকে পথ মাড়াইনি। আফসোস যদি সময়টা আবার ফিরে পাওয়া যেত!
আমার মা শিক্ষিতা ও উদ্যোগী। যদিও ভারতীয় উপমহাদেশে নারীর শ্রম অর্থহীন। তবু তিনি হাঁস-মুরগী পালন করতেন ও তাদের বাচ্চা ও ডিম বিক্রি করে সে টাকা পারিবারিক উন্নয়নে কাজে লাগাতেন। এছাড়াও এখনও তিনি সেলাই মেশিন চালান। আমার স্বাস্থ্যের কল্যাণে প্রায় প্রতিটি জামাতেই মার করা সেলাইয়ের আদর আছেই। আবার তিনি লাউ, কুমড়া ইত্যাদিও রোপণ ও পরিচর্যা করতেন। আমার বাগান করা ও গাছ-গাছালির প্রতি যে ভালবাসা তার সূত্রপাত এখান থেকেই। মা এখনো আমার খাবারের প্রতি উদাসীনতা কমানোর জন্য অনেক কষ্ট মিশ্রিত চেষ্টা করেন। আর বাড়িতে গেলে বলার আগেই সব সময় আমার পছন্দের খাবার তালিকা, পিঠা, সবজি ইত্যাদি মায়ের যাদুকরী হাতের পরিশ্রমে একে একে হাজির হয়। যদিও আমার আজ যা পছন্দ কাল তা পছন্দ নাও হতে পারে তাই মার উপর খুবই অত্যাচার করা হয়। অনেক কিছু বুঝতে পারলেও আমি করতে পারি না। অপরদিকে মাও আমাকে অতিরিক্ত অপত্য আদর করা থেকে বিরত হতেই পারেন না।
বড় হওয়ার সাথে সাথে অনেক কিছু আর করতে পারি না। তার মাঝে আছে মধ্যবিত্ত পারিবারিক স্ববিরোধী নীতি। তাই যতই বহির্মুখী হই না কেন কোন দিন বাবা-মাকে বলতে পারি না আমার কাছে FAMILY মানে Father And Mother I Love You। তাদের জন্য কোন উপহার কিনেও তাদেরকে দিতে কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে। তবে কিছু জিনিস আছে যা না বললেও বুঝতে কষ্ট হয় না। আমার বিশ্বাস বাবা-মা এগুলো বোঝেন। কিন্তু আমার মন ভরে না। আমি যদি কখনো একটি খারাপ কাজও করি তবু তাদের সাথে শেয়ার করি কিন্তু জীবনের এত বড় একটা সত্য কেন যেন বলতেই পারি না। তাই মা দিবসে এই সত্যের লিখিত প্রকাশই আমার বাবা-মার প্রতি আমার উপহার।