বৃহস্পতিবার, ২৭ ডিসেম্বর, ২০১৮

নির্বাচন ও রাজনীতিঃ আমরা কেন ভোট দেবো?



এরিস্টটলের ভাষায় ‘মানুষ রাজনৈতিক জীব।‘ তাই আমরা চাই বা না চাই আমরা জন্মগতভাবেই ভাল-মন্দ উভয় রাজনীতির শিকার। আর ভোটাধিকার হচ্ছে একজন নাগরিকের রাজনৈতিক অধিকার। তাই, রাষ্ট্রের একজন নাগরিক হিসেবে ব্যক্তির অভিব্যক্তি, মতামত, প্রতিবাদ, দ্রোহ, ক্ষোভ, ভালোবাসা, ত্যাগ, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ আশা-প্রত্যাশার বহির্প্রকাশের প্রতিচ্ছবি হচ্ছে ভোট। সমাজে ব্যক্তির একটা অবস্থানও নির্ণীত হয় ভোটাভুটি কিংবা নানা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। ‘না ভোট’টাও কিন্তু প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে এক নীরব প্রতিবাদ, যদিও ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে নাগরিকের সেই অধিকারটাকেও খর্ব করা হয়েছে। আজ যারা নিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে ব্যস্ততা, নানা সমস্যা, অসচেতনতাবশত কোনো ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় না কিংবা নিতে পারে না তারা এক অর্থে বঞ্চিত। কিংবা ভিন্ন থিওরি মাথায় আপলোড করে চলমান বিচ্ছিন্নতা বা বৈরী প্রতিবেশ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাইছেন, কিন্তু পারছেন না। এক্ষেত্রে প্রবীর ঘোষের সেই লাইনটা প্রণিধানযোগ্য ‘কোন অসুস্থ্ সমাজ ব্যবস্থায় সুস্থ্ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য।‘ বিদ্যমান সিস্টেম বদলানো কিংবা উন্নতি-অবনতির প্রাসঙ্গিকতায় যাদের নিষ্ক্রিয় অবস্থান, এই শ্রেণির মানুষগুলোর অপর নাম ‘নিরীহ’, ‘নিরপেক্ষ', 'রাজনীতি উদাসীন', 'সাঃ আমজনতা'যাদের মুখ থেকেই বেশি শোনা যায় ‘রাজনীতির মধ্যে যাইয়ো না,' 'কী অইবো ভোট দিয়া', 'অত গ্যাঞ্জামের মধ্যে যাইয়ো না', 'প্রতিবাদ কইরা লাভ নাই', 'নিজে ভালা থাকলেই জগৎ ভালা', 'ওইখানে আমার তো কোন লাভ নাই আমি যামু ক্যা', 'যা মুনে অয় তাই হউকগা, তাতে তোমার কী' ইত্যাদি মানুষকে আলটিমেটলি নিরুৎসাহিত-স্তব্দ-নিষ্ক্রিয় করার ঔচিত্যমূলক অমৃত বচন! সমাজে এই মানুষগুলোই সবচেয়ে অসহায়, শোষিত-বঞ্চিত-লাঞ্চিত হয়ে আসছে অতীতে-বর্তমানে এমনকি ভবিষ্যতেও হবে। কেননা, আমাদের সমগ্র জীবন তথা ভোর থেকে রাত, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত ব্যবহার্য জিনিসপত্র, মৌলিক বিষয়াবলি, বাজারের পণ্য, চাল-ডাল-তেল-নুন-গ্যাস-বিদ্যুৎ, এসবের প্রকৃত বা ন্যায্য মূল্যের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, এলাকাস্থ মানুষ-আত্মীয়-বন্ধু-উপরতলা-নিচতলার মানুষের সাথে অপর মানুষের সম্পর্কগুলোও ক্ষমতাতান্ত্রিক রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত। কেননা, এসব কিছুই রাজনীতি তথা ব্যবসায়ীদের দ্বারা নির্ণীত ও নিয়ন্ত্রিত। মানুষ ক্ষমতার পূজারী, তাই ক্ষমতাতন্ত্রের আশেপাশে থেকে রাজনৈতিক সুবিধাদি ভোগ করে ঐ 'নিরীহ' শ্রেণির 'সাধারণ জনতা'কে হারিয়ে-ঠকিয়ে-ভয় দেখিয়ে-লোভ দেখিয়ে-চাপ প্রয়োগ করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমি কোন পক্ষে যাবো- ডোমিনেট করবো নাকি ডোমিনেটেড হবো? সবহারাদের দলে নাকি সর্বহারাদের উদ্ধার করে বিদ্যমান অচলায়তনে পরিবর্তনকামী-কর্মীদের দলে? সচেতনদের দলে নাকি অচেতনদের দলে? সেই সাথে বর্তমান সময়ে আরও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন-পাকপন্থী রাজাকারদের পক্ষে নাকি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে? চেতনাধারীদের পক্ষে নাকি চেতনাহীনদের পক্ষে নাকি চেতনা ব্যবসায়ীদের পক্ষে? সিদ্ধান্তটা আপনার। একেকটা নির্বাচন মানে রাষ্ট্রের ক্রান্তিকালীন সময়। এসময় আপনাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে সচেতনচিত্তে। বিন্দুমাত্র অবচেতন আর চৈতন্যহীনতার সুযোগে দেখবেন একদিন পরিবার-সমাজে-এলাকায়-রাষ্ট্রে আপনার চিহ্নমাত্র নেই। আপনার নিজ জীবন, গৃহ, পরিবার-পরিজন, ভাই-বোন-সন্তান, আপনার ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার, চাকরি-ব্যবসা, প্রতিষ্ঠান এমনকি অপরজনার সাথে সম্পর্কও নিরাপত্তাহীনতার চাদরে ঢাকা পড়বে; যেথায় একটু ঝড়ো বাতাসে (কারও থ্রেটে) উড়ে যাবে, হালকা বৃষ্টিতে (ফাঁপর) ভিজে চুপসে যাবে। দেখবেন, আপনি বেঁচে আছেন অথচ সমাজ ও জাতীয় নিবন্ধন তালিকা হতে আপনার নামটিও উধাও হয়ে গেছে। ভোট দিতে এসে দেখবেন আপনার ভোট অন্য কেউ দিয়ে গেছে অথচ আপনার বলার-প্রতিবাদের ভাষা নেই, কারণ আপনি মেরুদণ্ডহীন 'নিরীহ-অসচেতন' মানুষ নামের মস্তিষ্কহীন জীব। অমুক বলে কেউ একজন আছে/ ছিল এটা মানুষ ভুলে যাবে, আর আপনি হয়ে যাবেন এই একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবী নামক গ্রহের বাংলাদেশের হোমো সেপিয়েন্স প্রজাতির প্রাণী। সুতরাং, ব্যক্তি তথা নিজ প্রয়োজনেই প্রত্যেকেরই রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। আর সেটার প্রতিফলন হোক একটা সুষ্ঠু-স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভোট দানের মাধ্যমে। স্বাধীনতার ৪৮তম বিজয় দিবসে একটি সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়তে রাষ্ট্রীয় বাইবেল সংবিধান বর্ণিত ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’, ‘সমাজতন্ত্র ও শোষণ হইতে মুক্তি’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা’ এই চার মূলনীতি যিনি লালন-পালন ও ধারণ করেন এমন ব্যক্তিকেই ভোট দিন। রাষ্ট্রের মালিক যেহেতু জনগণ সেহেতু নির্বাচনে জনগণের দ্বারা জনগণের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হোক একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এটাই একজন ভোটারের প্রত্যাশা।



* (অভয়ারণ্য (Sanctuary) কর্তৃক প্রকাশিত বিজয়োৎসব সংখ্যা 'পুনর্জন্ম'তে প্রকাশিত) 

বৃহস্পতিবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৮

মাদক, বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতন রোধে তারুণ্য


স্থান-কাল-পাত্র, জাতি-ধর্ম-বর্ণ, দল-মত-লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষের জীবনের সবচেয়ে সোনালী সময় হল যৌবনকাল। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে যে, যৌবনের প্রচণ্ড গতিবেগ ও অদম্য শারীরিক-মানসিক শক্তির রীতিমত অপচয় হচ্ছে। কেননা, যে বয়সে প্রতিটি যুবক-যুবতীর নিজের সৃজনশীল কাজের দ্বারা নিজের এলাকা কিংবা দেশকে সহজেই সারা বিশ্বের কাছে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব, সে সময় একজন তরুণ হয়তো অকালে শেষ হয়ে যাচ্ছে আসক্তির ফলে। অপরদিকে, একজন তরুণীকে বাল্যবিয়ে বা নারী নির্যাতনের শিকার হয়ে গুটিয়ে বাঁচতে হচ্ছে বাকীটা জীবন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই যে অসীম সম্ভাবনার অপব্যবহার হচ্ছে তা ইচ্ছাকৃত, অনেক ক্ষেত্রে তা অনিচ্ছাকৃত। তবে অদূরদর্শী সম্মতি বা অনিচ্ছাকৃত অবদমনে অজ্ঞাতসারে ক্ষতিটা কিন্তু হচ্ছে শেষমেষ পরিবার, সমাজ, দেশ কিংবা রাষ্ট্রের; যার ক্ষতিপূরণ দেওয়া এক কথায় অসম্ভব। তাই, এই মুহূর্তে এ তিন মহামারী রোগ থেকে সমাজকে সুস্থ করতে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে বিশেষ করে তরুণদেরকে।
মাদকঃ মানুষ নেশার জন্য যা ব্যবহার করে তাই মাদক দ্রব্য। সেটি হতে পারে ইনজেকশন, ধূমপান বা যে কোন মাধ্যম। তাই বলা যায় যে, হিরোইন, কোকেন, ইয়াবা, আফিম, মারিজুয়ানা, গাঁজা, ফেনসিডিল, বিয়ার, কেটামিন, স্পিড, বিভিন্ন রকমের ঘুমের ওষুধ থেকে শুরু করে জুতা লাগানোর আঠা পর্যন্ত সবই মাদকদ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত। জাতিসংঘ মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (UNDCP) মাদকের যে সংজ্ঞা দিয়েছে তা হল Intoxication (N): It is the state that results from the intake of a quantity of a substance which exceeds the individual’s tolerance and produces behavioral and physical abnormalities. মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ (সংশোধিত ২০০৪) অনুযায়ী “মাদকদ্রব্য” অর্থ প্রথম তফসিলে উল্লিখিত কোন দ্রব্য এবং এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে সরকার কর্তৃক, সরকারী গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, মাদকদ্রব্য বলিয়া ঘোষিত অন্য কোন দ্রব্য। এক্ষেত্রে ৩টি শ্রেণিতে মাদকদ্রব্যগুলোকে ভাগ করা হয়। ক-শ্রেণির মাদকদ্রব্য (হেরোইন, কোকেন এবং কোকা উদ্ভূত মাদকদ্রব্য, পেথিডিন, মরফিন ও টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল, অপিয়াম, ক্যানাবিস রেসিন বা অপিয়াম উদ্ভূত, মেথাডন ইত্যাদি), খ-শ্রেণির মাদকদ্রব্য (গাঁজা বা যে কোন ভেষজ ক্যানাবিস, ফেনসাইক্লিআইন, মেথাকোয়ালন এলএসডি, বারবিরেটস এ্যামফিটামিন, অথবা এইগুলির যে কোনটি দ্বারা প্রস্তুত মাদকদ্রব্য ইত্যাদি) এবং গ-শ্রেণির মাদকদ্রব্য। এছাড়া “মাদকাসক্ত” অর্থ শারীরিক বা মানসিকভাবে মাদকদ্রব্যের উপর নির্ভরশীল ব্যক্তি বা অভ্যাসবশে মাদকদ্রব্য ব্যবহারকারী। আবার, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১২) অনুসারে “তামাক” অর্থ কোন নিকোটিনা টাবাকাম বা নিকোটিনা রাসটিকার শ্রেণিভুক্ত উদ্ভিদ বা এতদ্‌সম্পর্কিত অন্য কোন উদ্ভিদ বা উহাদের কোন পাতা বা ফসল, শিকড়, ডাল বা উহার কোন অংশ বা অংশ বিশেষ। “তামাকজাত দ্রব্য” অর্থ তামাক, তামাক পাতা বা উহার নির্যাস হইতে প্রস্তুত যে কোন দ্রব্য, যাহা চোষণ বা চিবানোর মাধ্যমে গ্রহণ করা যায় বা ধূমপানের মাধ্যমে শ্বাসের সহিত টানিয়া লওয়া যায় এবং বিড়ি, সিগারেট, চুরুট, গুল, জর্দা, খৈনী, সাদাপাতা, সিগার এবং হুক্কা বা পাইপের ব্যবহার্য মিশ্রণও (mixture) ইহার অন্তর্ভুক্ত। আর “ধূমপান” অর্থ কোন তামাকজাত দ্রব্যের ধোঁয়া শ্বাসের সহিত টানিয়া নেওয়া বা বাহির করা, এবং কোন প্রজ্বলিত তামাকজাত দ্রব্য ধারণ করা বা নিয়ন্ত্রণ করাও ইহার অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে দেশের মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ (স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়)। আরও ভীতিজনক তথ্য হলো, প্রতি ১৭জনে একজন তরুণ মাদকাসক্ত। UNDCP’র তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর বিক্রি হওয়া ইয়াবার মাত্র ১০% ধরা পড়ে। ২০১৬ সালে দেশে ২ কোটি ৯৪ লাখ ইয়াবা ধরা পড়ে যা মোট বিক্রির (৪০ কোটি) কিয়দংশ। আমাদের রাষ্ট্রীয় বাইবেল সংবিধানের ১৮তম অনুচ্ছেদ (জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা)-এ আমরা দেখতে পাই, (১) জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতিসাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন এবং বিশেষতঃ আরোগ্যের প্রয়োজন কিংবা আইনের দ্বারা নির্দিষ্ট অন্যবিধ প্রয়োজন ব্যতীত মদ্য ও অন্যান্য মাদক পানীয় এবং স্বাস্থ্যহানিকর ভেষজের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷ (২) গণিকাবৃত্তি ও জুয়াখেলা নিরোধের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন৷ এছাড়াও অতি সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সাথে খেলোয়াড়দের মত ডোপ টেস্ট সংযুক্ত করার পরিকল্পনাটি নিঃসন্দেহে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।
বাল্যবিয়েঃ শিশু আইন, শিশুনীতিসহ বিভিন্ন আইন ও নীতি এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদসহ বিভিন্ন সনদ অনুসমর্থন করে সরকার ১৮ বছরের কম বয়সীদের শিশু হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তাই বলা যায়, ১৮ বছরের নিচের কোন নাবালিকাকে বিয়ে দেওয়াই (কারণ, তার সিদ্ধান্ত নেওয়ার বয়স হয় না) বাল্যবিয়ে। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০-এ বলা আছে “শিশু” অর্থ অনধিক ষোল বৎসর বয়সের কোন বালিকা। বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৪ নামে আইনের খসড়ায়  উল্লেখ  আছে, ‘যুক্তিসংগত কারণে মা-বাবা বা আদালতের সম্মতিতে ষোলো বছর বয়সে কোনো নারী বিয়ে করলে সেই ক্ষেত্রে তিনি “অপরিণত বয়স্ক” বলে গণ্য হবেন না।’ এছাড়াও বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৬ নামে আইনের খসড়ার ১৯ ধারায় আছে, এ আইনের অন্যান্য বিধানে যা কিছুই থাকুক না কেন বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্তবয়স্ক কোনো নারীর সর্বোত্তম স্বার্থে আদালতের নির্দেশে এবং পিতা-মাতার সম্মতিতে বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে বিয়ে হলে তা এই আইনে অপরাধ বলে গণ্য হবে না’। সুতরাং, আইন-আদালতের হিসেবে যাই থাকুক না কেন, ৬৪% বাল্যবিয়ে দেওয়া মেয়ের (প্রথম আলো, ৯-০২-’১৮) অকালে গর্ভধারণজনিত সংকট চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুযায়ী কিন্তু কোনক্রমেই কমে না।
নারী নির্যাতনঃ ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘ প্রকাশিত বিশেষ প্রতিবেদনে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা/ নির্যাতন সম্পর্কে বলা হয়েছে ‘নারী নির্যাতন এমন একটি নিন্দনীয় অপরাধমূলক কাজ যার ফলে নারী দৈহিক, মানসিক ও যৌন হয়রানির শিকার হয় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে।’ নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গে জাতিসংঘের সংগঠন প্রণীত নারী নির্যাতনের বিভিন্ন রূপের তালিকা নিম্নরূপঃ
পরিবার
দৈহিক আগ্রাসনঃ হত্যা যৌতুক ও অন্যান্য, দৈহিক আঘাত ও প্রহার, যৌন অঙ্গহানি, ভ্রূণ হত্যা, শিশু হত্যা, খাদ্য বঞ্চনা, চিকিৎসা সেবায় বঞ্চনা, প্রজনন ঘাটতি বলপ্রয়োগ/ নিয়ন্ত্রণ, যৌন অত্যাচার, ধর্ষণ, মানসিক অত্যাচার, আটকে রাখা, বলপূর্বক বিবাহ দান, প্রতিশোধের ভীতি প্রদর্শন
সম্প্রদায়
(সামাজিকগোষ্ঠী, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি)-এর ভিতরে বা বাইরে নারীর উপর নির্যাতনঃ দৈহিক অত্যাচার, দৈহিক আঘাত ও প্রহার, দৈহিক শাস্তি প্রদান, প্রজনন ঘাটতি বলপ্রয়োগ/ নিয়ন্ত্রণ, ডাইনী দাহ, সতীদাহ, যৌন হামলা, ধর্ষণ
কর্মস্থলে নির্যাতনঃ যৌন আগ্রাসন, হয়রানি, ত্রাস/ ভীতি প্রদর্শন, নারী পাচার, জবরদস্তি পতিতাবৃত্তি
তথ্য মাধ্যমঃ অশ্লীল সাহিত্য, নারীদেহকে বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করণ।
গোষ্ঠী
রাজনৈতিক নির্যাতন (নীতি, আইন ইত্যাদি): বেআইনী আউট, জবরদস্তি সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা বিনষ্টকরণ, জবরদস্তি গর্ভধারণ, অরাষ্ট্রীয় এজেন্টদের নির্যাতন বরদাস্ত করণ।
হেফাজতে নির্যাতন (সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ ইত্যাদি): ধর্ষণ, নিপীড়ন

নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডও সনদ তিনটি মৌলিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এগুলো হলঃ সমতা নীতি, বৈষম্যহীনতার নীতি এবং শরিক রাষ্ট্রের দায়-দায়িত্বের নীতি। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯, ২৭, ২৮ (১), (২), (৩), (৪) ও ২৯ (১), (২) অনুচ্ছেদে নারী-পুরুষের সম অধিকারের কথা বলা আছে। এছাড়াও ১০, ২৬নং অনুচ্ছেদে উন্নয়নে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। ফলে, প্রশাসনে ১ম শ্রেণিতে ১০ এবং ২য় শ্রেণিতে ১৫ শতাংশ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। জাতীয় মহিলা সংস্থার মতে, নির্যাতন দৈহিক হতে পারে বা মানসিক হতে পারে। কাউকে দৈহিক কষ্ট দেওয়া, কাউকে প্রহার করা কিংবা কাউকে মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া, কাউকে পদে পদে খোঁটা দেওয়া সবই নির্যাতন। বাংলাদেশে নারী নির্যাতনের যেসব রূপ হামেশাই দেখা যায় সেগুলো হলঃ ১. শারীরিক নির্যাতন, ২. ধর্ষণ বা বলৎকার, ৩. যৌন হয়রানি, ৪. এসিড নিক্ষেপ, ৫. তালাক, ৬. যৌতুকের বলী, ৭. মানসিক নির্যাতন, ৮. আর্থিকভাবে নির্যাতন, ৯. নারী পাচার, ১০. গণিকা বৃত্তি, ১১. অশ্লীল সাহিত্য, ১২. বিজ্ঞাপনে ও সুন্দরী প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নারীকে পণ্যে পরিণতকরণ, ১৩. পরিবারে নারী নিগ্রহ, ১৪. অপহরণ, ১৫. উত্যক্ত করা বা মৌখিক নির্যাতন ইত্যাদি। নারীরা স্বামী বা সঙ্গী কিংবা সঙ্গী নন এমন পুরুষের দ্বারা শারীরিক ও যৌন উভয়প্রকার নির্যাতনের শিকার হন। এছাড়াও সঙ্গী দ্বারা মানসিক, অর্থনৈতিক এবং স্বামীর সাথে বয়স পার্থক্যের কারণজনিত নির্যাতনের শিকার হন। অপরদিকে সঙ্গী নন এরকম পুরুষ দ্বারা নির্যাতনের দৃষ্টিভঙ্গি, শৈশবে নির্যাতন, নারী সদস্য হিসেবে পরিবারে যৌন হয়রানি/ উত্যক্তকরণের অভিজ্ঞতার শিকার হন অনেক নারী। নারী নির্যাতন নিয়ে সরকারের প্রথম জরিপে দেখা যায় যে, ২০ থেকে ৩৪ বছর বয়সী নারীরা যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছেন। শহরের তুলনায় গ্রামে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে। এছাড়াও বাইরের মতো ঘরের ভেতরেও স্বামী ও অন্যান্য আপনজনের কাছেই নারী ঝুঁকির মধ্যে থাকেন এবং নির্যাতনের সম্মুখীন হন। বিয়ের আগেও প্রায় ৪২ শতাংশ ১৪ বছর বয়সের আগেই জোরপূর্বক যৌনসম্পর্ক করতে বাধ্য হন, আর ৩৫ শতাংশ নারীর প্রথম এ অভিজ্ঞতা হয় ১৯ বছর বয়সে পা দেওয়ার আগেই। অর্থনৈতিক নির্যাতনও গ্রামে একটু বেশি দেখা যায়। এমনকি ভোট দেওয়ার মত ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তেও তারা বাধ্য হন অন্যের মতামতে কাজ করতে।
নারী নির্যাতনের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত যে রূপগুলো বর্তমানে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে তাদের বর্ণনা নিম্নরূপঃ
ধর্ষণঃ নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে (২০০০) বলা আছে, নিজের স্ত্রী বাদে ১৬ বছরের বেশি বয়সী মেয়ের সম্মতি ছাড়া অথবা তাকে ভয় দেখিয়ে বা প্রতারণামূলকভাবে রাজি করিয়ে তার সঙ্গে সঙ্গম মানেই ধর্ষণ। তবে নিজ স্ত্রীর বিষয়টি ভিন্ন। তার বয়স ১৩-এর কম না হলে দণ্ডবিধিতে ধর্ষণ বিবেচনায় আনার সুযোগ নেই। ১৬ বছরের কম বয়সী কোন মেয়ের সাথে সম্মতিতে বা অসম্মতিতে যৌন মিলনকেও ধর্ষণ বলা হয়। তবে অনেকেই হয়তো জানেন না যে, অনেক পুরুষও ধর্ষণের শিকার হন। যেমনঃ যৌনানন্দ লাভ বা বিকৃত যৌনাচারের কারণে বয়েসী কোনো নারী দ্বারা নাবালক বা বয়েসে ছোট কারো ধর্ষিত হওয়া কিংবা জেল, মক্তব বা অন্যত্র অন্য পুরুষ দ্বারা ধর্ষিত হওয়া। তবে যেহেতু অধিকাংশ ধর্ষণ পুরুষরাই করে তাই ধর্ষণ বলতে নারী ধর্ষণকেই নির্দেশ করা হয়। ডা. এমএ হাসান পরিচালিত ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির তথ্য অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধকালীন ১ লাখ ৬২ হাজার নারী ধর্ষণসহ নির্যাতনের শিকার এবং আরও ১ লাখ ৩১ হাজার হিন্দু নারী স্রেফ গায়েব হয়ে গিয়েছিলেন। উন্নত দেশে ডেট রেপ বা অভিসার ধর্ষণ হলো ধর্ষণের প্রধান কারণ। তবে ভয়ের বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশেও ডেট রেপ ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে।
যৌতুক প্রথাঃ নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ অনুযায়ী “যৌতুক” বলতে বোঝায় কোন বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সহিত জড়িত বর পক্ষের অন্য কোন ব্যক্তি কর্তৃক উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে, বিবাহের পণ হিসাবে বিবাহের কনে পক্ষের নিকট দাবীকৃত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ; অথবা কোন বিবাহের কনে পক্ষ কর্তৃক বিবাহের বর বা বরের পিতা বা মাতা বা প্রত্যক্ষভাবে বিবাহের সহিত জড়িত কনে পক্ষের অন্য কোন ব্যক্তি কতৃক উক্ত বিবাহের সময় বা তৎপূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকার শর্তে, বিবাহের পণ হিসাবে বিবাহের বর পক্ষের নিকট দাবীকৃত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ। ২০১৭ সালে সংঘটিত নির্যাতনের ৩২% যৌতুকজনিত কারণে ঘটেছে (সমকাল, ৬-০৩-’১৮)।
পাচারঃ জাতিসংঘের মতে ‘শোষণের উদ্দেশ্যে হুমকি বা শক্তি প্রয়োগ অথবা অন্যান্য ধরনের বাধ্যকরণ, অপহরণ, প্রতারণা, বিশ্বাসহরণ, ক্ষমতার অপব্যবহার অথবা হুমকিপূর্ণ স্থান অথবা একজন ব্যক্তির উপর অপর ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ আরোপের উদ্দেশ্যে অর্থের লেনদেন বা সুবিধা আদায়করণ’।
মৌখিক নির্যাতনঃ যৌন নিগ্রহমূলক তীব্র বাক্যবাণের দ্বারা এ অপরাধ সংঘটিত হয়।
তারুণ্যঃ তরুণ বলতে একতরফাভাবে শুধু বয়সে কচি ছেলেকেই বুঝায় না। এটি একটি সর্বজনীন অভিধা যা নারী, পুরুষ এমনকি বৃদ্ধ-বৃদ্ধার ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য হতে পারে। তারুণ্য হলো মানসিক ও শারীরিক উভয় অবস্থার সর্বোচ্চ উন্নতির সমন্বিত শিখরবিন্দু। অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় তার বাহ্যিক বা শারীরিক তারুণ্যের কমতি নেই কিন্তু তার অভ্যন্তরীন জগৎ তারুণ্যের ছিঁটেফোঁটাহীন। আবার অনেকের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে তার মনে চিরবসন্তের তারুণ্য কিন্তু শরীরের জ্যামিতিক বলিরেখা বলছে তার বয়স বেড়েছে। মানুষের মনোজাগতিক শক্তিই মানুষকে অমিত তেজশক্তিতে বলীয়ান করে।
বর্তমান অবস্থাঃ গণমাধ্যমে মাদক, বাল্যবিয়ে কিংবা নারী নির্যাতনের যে চিত্র প্রকাশিত হয় তা নিশ্চিতভাবেই এ ধরনের ঘটনার ভগ্নাংশমাত্র। আবার, সব দেশেই এ বিষয়গুলো কম উত্থাপিত হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের হলিউডের অভিনেত্রীদের সাথে ঘটে যাওয়া যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদস্বরূপ ফেসবুকে মি টু হ্যাশট্যাগের ছড়াছড়ির কথা।
বাংলাদেশ একটি যৌন রক্ষণশীল দেশ। এছাড়াও এ দেশে যৌন শিক্ষা বা যৌনতা সম্পর্কিত গণধারণা অবৈজ্ঞানিক ও কল্পনাপ্রসূত। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ এখনও জানে না যে, স্ত্রীর সম্মতি ব্যতিরেকে যৌনসম্পর্ক স্থাপন এবং অন্যান্য যৌন অপরাধ সংঘটনকে একত্রে বৈবাহিক যৌন নিগ্রহ বলা হয়। আমাদের দেশে বৈবাহিক জীবনে এক বা একাধিকবার বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯০ শতাংশের বেশি নারী। কিন্তু এরচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক কথা হলো যে, বৈবাহিক ধর্ষণ সম্পর্কে অধিকাংশ নারীর ধারণাই নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে দেখা গেছে, এ দেশের ৮০ শতাংশ নারী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার। এছাড়াও তাদের তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সালে বাংলাদেশে নির্যাতিত নারীর ৮৭ ভাগ স্বামী/ সঙ্গী দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছিলো। অনেকে বলেন অশালীন পোশাক পরা বা তথাকথিত শারীরিকভাবে সুন্দরী মেয়েরা বেশি ধর্ষণের শিকার হয়। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায় যে, এ ধারণাগুলো সত্য নয়। এমনকি ধর্ষণের ক্ষেত্রে ৬৬% নারী দরিদ্র হলেও বৈবাহিক অবস্থা তেমন ধর্তব্যের বিষয় না। কেননা, বাস্তব জীবনে আমরা দেখি, ধর্ষিতা পূর্ণবয়স্ক নারীর সংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি নারীশিশু (সমকাল) এবং অনেক ছোট-ছোট ছেলেরাও ধর্ষণের শিকার হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী গত সাড়ে পাঁচ বছরে দেশে ৫,২৪৮জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা জানিয়েছে গত ৬ মাসে ১৪১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শিশু অধিকার ফোরামের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ৬ মাসে ২৯৮ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কিশোরীদের রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে উত্ত্যক্ত করা হচ্ছে, প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের হেনস্তা করা হচ্ছে, মুঠোফোনে আপত্তিকর ছবি তুলে তা প্রচার করা হচ্ছে। বছর দু-এক আগে আইসিডিডিআর,বি পুরুষদের ওপর একটি জরিপ চালায়। তাতে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, আপনি কি নারীকে অধস্তন মনে করেন? ৯৭ শতাংশ পুরুষের উত্তর ছিল হ্যাঁ। নারীদের মাধ্যমে যদি বাংলাদেশকে বিশ্বে পরিচয় দিতে হয় তবে বলতে হবে, বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মাতৃ মৃত্যুহারের দেশ। এখানে বয়স্ক নারী সাক্ষরতার হার পুরুষের তুলনায় কম, নারীর গড় আয়ু পুরুষের তুলনায় কম, নারী নির্যাতন সহনীয় মাত্রার উর্ধ্বে। সিডও সনদের দুইটি ধারার ২ নং এবং ১৬-১(গ) সরকারের সংরক্ষণ এখনও বলবৎ। ২ নং ধারাটিকে বলা হয় সনদের প্রাণ। এ ধারায় নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক রীতিনীতি, প্রথা, আচার-ব্যবহার, নিষিদ্ধ করা হয়েছে ও বৈষম্য বিলোপ করে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতার নীতিমালা গ্রহণের উপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং ধারা ১৬-১(গ)তে আছে বৈবাহিক সর্ম্পক বিদ্যমান অবস্থা ও বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের একই অধিকার থাকবে। পবিত্র কুরআন সুন্নাহ ও শরীয়ত আইনের বিরোধী বলে আপত্তি জানিয়ে বাংলাদেশ সরকার এই দুইটি ধারা সংরক্ষণ প্রত্যাহারের স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাচ্ছে না। অপরদিকে, যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০ মোতাবেক যৌতুক গ্রহণই নয়, যৌতুক প্রদান ও যৌতুক দাবি করাও শাস্তিমূলক অপরাধ। এ আইন অনুযায়ী যৌতুক দাবি করা কিংবা আদান-প্রদানের এক বছরের মধ্যে ফৌজদারী আদালতে মামলা করতে হবে। এজন্য দায়ী ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ৫ বছর সর্বনিম্ন একবছর কারাদণ্ড বা জরিমানা কিংবা উভয় শাস্তি প্রদান করা যাবে। এ আইনের অনেক ধারা-উপধারা রয়েছে যা আমরা অনেকেই জানি না। অথচ এটি জানা অত্যন্ত প্রয়োজন।
পুরো বাংলাদেশের এ ভয়াবহ চিত্রের একটি খণ্ডচিত্র আমাদের ধনবাড়ী উপজেলা, বিশেষত পৌরসভা। ইদানীং এলাকায় ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের অবাধ প্রাপ্যতা আমাদেরকে স্তম্ভিত করে। এছাড়াও চুপি-চুপি বাল্যবিয়ে এবং নারী নির্যাতন প্রকাশ না হলেও আশে-পাশের অনেকেই এর ভুক্তভোগী। এর কারণ পর্যালোচনা করলে বলা যায় যে, সামাজিক অবক্ষয় এর মূল কারণ। সামাজিক অবক্ষয় থেকে জন্ম নিচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। জনবিচ্ছিন্নতা বা ভার্চুয়াল জগতে মাত্রাতিরিক্ত সময় অপচয় যুবসমাজের মধ্যে তৈরি করছে হতাশা। যার ফলে কর্মহীনতা ও অন্যান্য হতাশা কাটানোর আপাত সমাধান হিসেবে বাড়ছে মাদকাসক্তি। অনেক ক্ষেত্রে মাদকাসক্তরাই হয়ে উঠছে বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতনের (২%) মূল কারণ।
উত্তরণের পথে তরুণদের সংযুক্ততাঃ আশার বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ বর্তমানে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ এখন কর্মক্ষম তরুণ। এই অসম্ভবকে সম্ভব করা তারুণ্যকে মাদক, বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতনের অসমসাহসিক যোদ্ধা হিসেবে ব্যবহার করা এখন সময়ের দাবী। তারুণ্যের রয়েছে অবাধ অপ্রতিরোধ্য সর্বভুক গতি। যে গতির কারণে উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু সর্বত্র সে সমভাবে পূজনীয়। কিন্তু এই গতিই তার দুর্বলতা, যা তাকে ধ্বংস করতে যথেষ্ট। গতিকে যদি সঠিক পথে পরিচালিত করা যায়, তবে তা চলার পথে সোনা ফলায়, কিন্তু গতি কুপথে গেলে তা অপেক্ষাকৃত বেশি ক্ষতি সাধন করে। বর্তমান প্রজন্মের তারুণ্য বিভ্রান্তি, বিশ্বাস ব্যবসায়, প্রলোভন, অনৈতিকতা, মেকি সুখের মায়া, অহংবোধ, হুজুগ, মাদক, যৌন বিকৃতি, সম্পর্কের ফাটল, অতিযান্ত্রিকতা, সকাল-সন্ধ্যা প্রেম, হতাশা, আত্মহত্যা প্রভৃতি নানা রকম ধোঁয়াশায় আবৃত। তাদের পৃথিবীকে পরিবর্তন করার মত শক্তি থাকা সত্ত্বেও তারা সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে ডাঙায় তোলা মাছের মত খাবি খাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একটাই পথ। তা হল যুগপৎভাবে স্বশিক্ষা ও সুশিক্ষা। একমাত্র মানবিক, বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদী শিক্ষাই পারে প্রবল তারুণ্যের বারুদশালায় দেয়াশলাই কাঠির মত কাজ করতে। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহায়ক হিসেবে প্রয়োজন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়া কিংবা বৌদ্ধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো। কেননা, সংগঠিত শক্তি যেকোন বৃহৎ অপরাধকে সহজেই পরাজিত করতে পারে। তরুণদের মনে রাখতে হবে, বর্তমানে আমরা কোনো রূপকথার রাজ্যে বসবাস করি না যে, রাজপুত্র এসে তার কারিশমা দিয়ে পরিস্থিতি অনুকূল করবেন। বরং একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবীতে আমরাই আজ একেকজন রাজপুত্র, সুপারম্যান, ব্যাটম্যান বা স্পাইডারম্যানের মত সুপার হিরো। পুরো পৃথিবীটাই আজ আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এক্ষেত্রে অনেক দুরাশার মাঝে একটি আশার আলো আমিসহ প্রায় সব অধূমপায়ী সদস্যদের সংগঠন অভয়ারণ্য (Sanctuary)। মাদক নিরাময়ে এ সংগঠনের বেশ কিছু অপ্রকাশিত ব্যক্তিপর্যায়ের কাউন্সেলিং ও গাইডেন্স পরিচালিত হয়ে আসছে। আবার, গত ৪ সেপ্টেম্বর (২০১৭) রাতে সংগঠনটির এক সদস্যের তৎপরতায় পূর্ববর্তী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জনাব শামীম আরা রিনির হস্তক্ষেপে বন্ধ হয় একটি বাল্যবিয়ে। এছাড়াও গত ২৪ এপ্রিল (২০১৮) বিকেলে সংগঠনের সদস্যদের মাধ্যমে বন্ধ হয় একটি পাচার ও শিশুধর্ষণ।
সুপারিশ/ প্রস্তাবনাঃ

প্রতিরোধমূলকঃ
১। অবকাঠামো উন্নয়নের মত এক্ষেত্রেও পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের ভিত্তিতে একটি নাগরিক সেল গঠন করতে হবে। সংগঠন ও প্রশাসনের সম্মিলিত উদ্যোগে এটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন সেলের মত কাজ করবে।
২। সাংস্কৃতিক, সামাজিক কর্মকাণ্ড ও খেলাধূলায় তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে উপজেলা শিল্পকলা একাডেমি স্থাপন ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থার কার্যাবলি বৃদ্ধি করতে হবে।
৩। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধে নিজস্ব সংস্কৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে কেন্দ্রীয়ভাবে কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
৪। মূল্যবোধের জাগরণের জন্য যৌনশিক্ষা প্রবর্তন ও নৈতিক শিক্ষা জোরদার করতে হবে। লিঙ্গ বা অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সব মানুষ সমান, এ চিন্তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। যেকোন অপরাধীর ‘ভিলেন ইমেজ’ তৈরি করতে হবে। অপরাধী যতই আপনজন হোক না কেন, তাকে ‘সোশ্যাল আউটকাস্ট’-এর দৃষ্টিতে দেখার গণদৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে।
৫। ধর্ষণ সংক্রান্ত আইন ১৮৭২, বাল্য বিবাহ নিরোধ আইন ১৯২৯ (সংশোধিত ’৮৪), মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১, বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) আইন ১৯৭৪, যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন ১৯৮০ (সংশোধিত ’৮৬), পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ ১৯৮৫, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ (সংশোধিত ২০০৪), নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০, আইনগত সহায়তা প্রদান আইন ২০০০, এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৫ (সংশোধিত ২০১২), ভ্রাম্যমান আদালত আইন ২০০৯, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন ২০১২ ইত্যাদির যুগোপযোগী নবায়ন ও কার্যকর বাস্তবায়ন করতে হবে।
৬। বেকারত্ব নিরসনে আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে তরুণদেরকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংযুক্ত করতে হবে।

প্রতিকারমূলকঃ
১। ইতিবাচকভাবে আসক্তদেরকে পূর্বের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার জন্য সহযোগিতা করতে হবে।
২। অভিযুক্তদের রাজনৈতিক আশ্রয় বা অন্য কোন প্রকার প্রশ্রয় না দিয়ে অবশ্যই বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। সালিশের মাধ্যমে নামমাত্র জরিমানায় মীমাংসা অথবা অভিযুক্তদের সাথে বিয়ে দেওয়ার মত হাস্যকর সমাধান বাদ দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক উন্মুক্ত বিচার করতে হবে। এতে ভবিষ্যতে অন্যরা অপরাধ করতে নিরুৎসাহিত হবে। বিচার বহির্ভূত হত্যা বন্ধ করতে হবে। কেননা, হত্যা কোন সমাধান নয়, বরং এটি মানবাধিকার হরণ।
৩। ভুক্তভোগীকে অপরাধবোধ কিংবা গ্লানি থেকে বের করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ অনুযায়ী সংবাদ মাধ্যমে নির্যাতিতা নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বাধা-নিষেধ মেনে চলতে হবে। অপরাধের শিকার হয়েছেন এরূপ নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তৎসম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোন সংবাদ পত্রে বা অন্য কোন সংবাদ মাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করতে হবে যাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়।
৪। প্রায় পাঁচ লাখেরও বেশি আক্রান্ত নারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে সাধারণত তারা যে ৩টি কারণে ধর্ষণ রিপোর্ট করতে দ্বিধাবোধ করেনঃ ক. ব্যক্তিগত স্পর্শকাতরতা; খ. ধর্ষক বা তার পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে আরো হুমকি বা প্রাণ-নাশের আশংকা; গ. পুলিশ অথবা বিচার বিভাগের উদাসীনতা, যথেষ্ট পদক্ষেপ না নেওয়া কিংবা নিজেরাই নাজেহাল হওয়ার আশঙ্কা (Wright, 1991)।। এক্ষেত্রে তাদের সুরক্ষার ব্যাপারটি পুলিশ প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে।
৫। অপরাধীর বিকৃত মানসিকতার ও ভুক্তভোগীর পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।


শামীম আল মাহমুদ (শিমুল)
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, অভয়ারণ্য (Sanctuary)
(গত ১২ জুন ধনবাড়ী উপজেলা অডিটোরিয়ামে 'মাদক, বাল্যবিয়ে ও নারী নির্যাতন রোধে তারুণ্য' শীর্ষক সেমিনারের মূলপ্রবন্ধ হিসেবে পঠিত)

বৃহস্পতিবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৮

নক্ষত্র ঝরা নিষ্ঠুরতম মাস আগস্ট


ইংরেজী সাহিত্যের কবি টিএস ইলিয়ট লিখেছিলেন `April is the cruelest month’। তিনি যদি বাঙালি হতেন তাহলে হয়ত আবার লিখতেন- August is the cruelest month। এই বাংলায় ডেড ল্যান্ড নেই, সেই লাইলাক ফুলও ফুটে না। তবে ফুলের মতো সৌন্দর‌্য আর সৌরভ বিলানো মানুষেরা অকালমৃত হয়ে ঝরে পড়ে বাংলার উর্বর ভূমি থেকে এই আগস্ট মাসে।
এই বাংলায় রবীন্দ্রনাথ-নজরুলরা যেমন প্রতিদিন জন্মায় না, তেমনি হাজার হাজার বছরে মাত্র একবারই জন্মায় ক্ষুদিরাম-নেতাজি-বঙ্গবন্ধু-তারেক মাসুদেরা। আর বাঙালিদের কাঁদিয়ে আগস্টেই চলে গেছেন তাঁরা! কেমন যেন আগস্ট আসলেই শোকের বারতায় ভরে যায় ক্যালেন্ডারের পাতা, হিসেবের খাতা।
রবিহারা আগস্ট

ছবি: ইন্টারনেট
এই আগস্টেই ঝরে গেছেন বাংলার আকাশের প্রতিদিনের সূর‌্য রবীন্দ্রনাথ। শান্তিনিকেতনে দীর্ঘদিন প্রোস্টেট ক্যান্সারে ভুগে রোগশয্যায় ছিলেন। তারপর ১৯৪১ সালে তাঁকে কলকাতার পৈত্রিক বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। বাংলার আকাশের প্রতিদিনের সূর‌্য ডুবে গেলেন এই আগস্টেই।
‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’
সময়টা ১৯০৮ সালের ১১ আগস্ট ভোর পাঁচটা। ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়ালেন বিপ্লবী ক্ষুদিরাম। কারাফটকের বাইরে তখন হাজারো জনতার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে ‘বন্দেমাতরম’স্লোগান। কারা কর্তৃপক্ষ যুবকটির কাছে জানতে চাইল, মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ ইচ্ছা কী?
ছবি: ইন্টারনেট
ক্ষুদিরাম নিঃশঙ্কচিত্তে বলে উঠলেন, ‘আমি ভালো বোমা বানাতে পারি, মৃত্যুর আগে সারা ভারতবাসীকে সেটা শিখিয়ে দিয়ে যেতে চাই।’ তারপর ফাঁসির মঞ্চে ঝুলে গেলেন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ক্ষুদিরাম। সেই সাথে এই আগস্ট মাসেই বাংলার আকাশ থেকে একটা বিপ্লবী তারা খসে গেলো।
ঝরা কাগজের ফুল সেলুলয়েডের কারিগর
যে ‘কাগজের ফুল’ তিনি সেলুলয়েডের পর্দায় ফোঁটাতে চেয়েছিলেন সেই ফুলটা প্রস্ফুটত হওয়ার আগেই পাবনার ইছামতী নদীর তীরে থেকে ফেরার পথে ঝরে যায় আজকের এই দিনে।
ছবি: ইন্টারনেট
সময়টা মধ্য দুপুর, ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক। হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে একটি বাস এসে মাইক্রোবাসটির উপর চালিয়ে দেয়। রক্তলাল পাপড়ি দুটো(তারেক মাসুদ-মিশুক মনির) মুহুর্তেই ঝরে পড়ে। এই আগস্টেই জাতি হারায় তার আরও দুই শ্রেষ্ঠ সন্তান।
শোকাবহ আগস্ট
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোরের আজানের ধ্বনির পর পরই ক্রসফায়ারের মুহুর্মুহু শব্দে কেঁপে উঠলো ধানমণ্ডির ৩২ নাম্বার বাড়ী।
মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর ডালিমের নেতৃত্বে মেজর নূর, হুদা, মহিউদ্দিন সহ আর কিছু বিপথগামী সৈন্যরা আক্রমণ করলো বঙ্গবন্ধুর বাড়ী।
সময়টা ভোর ৫টা ৪০ মিনিট। বঙ্গবন্ধু সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসবেন ঠিক তখনই দ্বিতীয় তলায় তাকে পেলেন মহিউদ্দিন। মহিউদ্দিন আমতা আমতা করে বললো, ‘স্যার, আপনি আসুন’।
বঙ্গবন্ধু কর্কশ ভাষায় বললেন, ‘তোমরা কী চাও? তোমরা কী আমাকে খুন করতে চাও? ভুলে যাও। পাকিস্তানী বাহিনী তা করতে পারেনি, তোমরা কী মনে করো তোমরা তা করতে পারবে?’
ছবি: ইন্টারনেট
ঠিক তখনই মেজর নূর এসে হাজির। মহিউদ্দিনকে সরিয়ে দিয়ে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই নূর চিৎকার করে ব্রাশ ফায়ার চালালো বঙ্গবন্ধুর বুকে। সঙ্গে সঙ্গে স্টেনগানের গুলি বঙ্গবন্ধুকে ভেদ করে দেয়ালে গিয়ে লাগলো। নিথর দেহটা সিঁড়ির মধ্যে পড়ে রইলো। রক্তে ভেসে গেলো পুরো সিঁড়ি, মুজিবের সাদা পাঞ্জাবি আর ধুসর বর্ণের লুঙ্গি। আর ডান হাতে ধুমপানের পাইপটা থাকলেও বাঙলার আকাশে ভোরের সূর‌্য উঠার আগেই ‘রাজনীতির কবি’র জীবন প্রদীপ নিভে গেলো। সেই সাথে আগস্ট মাস বাঙালির কাছে হয়ে গেলো শোকাবহ আগস্ট।
নেতাজির অন্তর্ধানের আগস্ট
"তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব" এই উক্তির প্রণেতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু।
নেতাজি সুভাষ চন্দ্র পরপর দুইবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত দ্বন্দ্বের জেরে তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়। নেতাজি সুভাষচন্দ্রই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন। কারারুদ্ধ করে ভারত থেকে নির্বাসিত করা হয়। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে ভারতে ফিরে এলে আবার তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। এভাবে তিনি ১১ বার কারারুদ্ধ হন।
ছবি: ইন্টারনেট
দেশে বিপুল জনসমর্থন গড়ে উঠে নেতাজির। তার বিরুদ্ধে দেশী-বিদেশী একটা চক্র কাজ করতে থাকে। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইওয়ানের তাইহোকুতে একটি বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যু হয়। তবে তাঁর এই মৃত্যু নিয়ে আজও বিতর্ক রয়ে গেছে। বিতর্ক থাকলেও আগস্ট মাসেই বাঙালি হারায় তার আরেক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে।
মহাবিদ্রোহীর মহাপ্রয়াণ
নজরুল বেঁচে থাকতে পেয়েছেন উপেক্ষা আর মৃত্যুর পর পেয়েছেন সম্মান। আমাদের বিদ্রোহী কবি নজরুলের ক্ষেত্রে হুমায়ুন আজাদের একটা উক্তি বেশ প্রযোজ্য- “বাঙালি মুসলমান জীবিত প্রতিভাকে লাশে পরিনত করে, আর মৃত প্রতিভার কবরে আগরবাতি জ্বালে।” নজরুলের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। অসুস্থ নজরুল তার প্রাপ্য সেবা-চিকিৎসা পাননি। দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে ধুকে ধুকে জীবনের শেষ দিনগুলো পার করেন।
নজরুল যখন মৃত্যু পথযাত্রী তখন তাকে তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশে এনে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয়। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানের জন্য ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুলকে ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাকে দেয়া হয় একুশে পদক।
ছবি: ইন্টারনেট
বিদ্রোহীর জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মহাবিদ্রোহী রণে ক্লান্ত হয়ে চিরতরে ঘুমিয়ে পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে। এক কবিতায় তিনি এই অন্তিম ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন, “মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই/যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই।” এই আগস্টেই বাংলা সাহিত্যের আরেক দিকপাল হারিয়ে যায়।
বাংলার তারকা-মহাতারকারা এই নিষ্ঠুর আগস্টেই বাংলার মহাকাশ থেকে থেকে ঝরে গেছেন। তাই বাঙালির জীবনে আগস্ট শোকের মাস, বেদনার মাস। এদেশের বুকে যেন এমন শোকাবহ আগস্ট আর না আসে এটাই বাঙালির প্রত্যাশা।

শরীফ আহমেদ
সাব-এডিটর

নিউজলাইনবিডি.কম

ধনবাড়ী অথবা ধনবাড়িঃ ঐতিহ্য ও আধুনিকতার চিরায়ত দ্বন্দ্ব


আমাদের এলাকার অধিবাসীদের মধ্যে উপজেলার নামের বানান ঈ-কার দিয়ে বহুল পরিচিত হলেও ইদানীং তা ই-কার সহযোগে লেখার প্রচেষ্টাও পরিলক্ষিত হচ্ছে ফলে বাড়ছে দ্বিধা তবে এই যে সংস্কার ও সনাতন, এর মাঝে কোনটি ঠিক তা একটি বিতর্কিত ও আপেক্ষিক বিষয় তবে বিভিন্ন সংগঠন ও গোষ্ঠীর সাথে কাজ করতে গিয়ে দুটি বানান ব্যবহার করা একটি স্ববিরোধের পর্যায়ে পড়ে তাই একজন যুক্তিবাদী সচেতন নাগরিক হিসেবে কোন রকম ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত না দিয়ে আমি দুটি প্রস্তাবনার পক্ষে শুধু যুক্তি উপস্থাপন করছি আমার মত স্ববিরোধিতার অস্বস্তি কাটাতে চাইলে বাকী দায়িত্ব আপনার

-কার ব্যবহারের পক্ষে যুক্তিঃ
ভাষাকে সুবিধাজনক করতে গিয়ে খুব দ্রুত বানান পরিবর্তন করলে দুই প্রজন্মের চিন্তার পার্থক্যের মত বানান পার্থক্যও খুবই বেশি হবে তাই পরিবর্তন করা এক্ষেত্রে অনুচিত
বানানের ফলে উচ্চারণ পার্থক্য হয় না কেননা, ‘মনশব্দটির বানান দেখে উচ্চারণ ম ও ন-এর স্বাধীনভাবে ব্যবহার হলে যেরকম উচ্চারণ হয় তা করে না বরং উচ্চারণ করেমোন্ তাই অন্য বানান গুরুত্বহীন
আগের বানান ঠিক রাখার ক্ষেত্রে জনসমর্থন অনেক বেশি তাই গণতান্ত্রিক মতবাদের ভিত্তিতে বানানটি অপরিবর্তিত থাকা দরকার
বেশিরভাগ মানুষের কাছেই আগের বানানটি ব্যবহার একটি কমফোর্ট জোন হিসেবে বিবেচ্য তাই এটিই থাকুক এতে বানান ভুল হবার সম্ভাবনাও কমবে
প্রায় সবাই আগের বানানটিতে অভ্যস্ত তাই অপ্রচলিত অনভ্যস্ততাকে সরিয়ে রাখাই ভালো

ই-কারের পক্ষে যুক্তিঃ
১। ভাষা মানুষের জন্য, মানুষ ভাষার জন্য নয়। তাই মানুষের সুবিধার জন্য ভাষাকে পরিবর্তিত হতে হবে।
উচ্চারণ ঠিক রাখতেই বানানের উদ্ভব তাই যদি না হতো তাহলে বিশ্বের সকল হরফের উচ্চারণ নির্দিষ্ট করতে IPA বা International Phonetic Alphabet প্রবর্তন করার প্রয়োজন পড়তো না এজন্য একই রকম উচ্চারণকে সংরক্ষণ করতে ভিন্ন বানান অপ্রাসঙ্গিক
নতুন বানানের প্রতি জনসমর্থন কম হলেও সমর্থনকারীরা প্রগতিশীল শ্রেণির প্রতিনিধি এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার সতীদাহ প্রথা নিবারণের লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের কাছে করা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করা ব্যক্তির চেয়ে প্রথাটি চালু রাখার ব্যাপারে করা রাজা রাধাকান্ত দেবের আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করা লোকের সংখ্যা ছিল ঢের বেশি কিন্তু আমার মত অত্যল্প ইতিহাস জানা লোকও জানেন যে, ‘প্রগতিশীল ব্যক্তির সংখ্যা সমাজে কমএ বিবেচনায় জয়ী হয়েছিল কম জনসমর্থিত প্রস্তাবটি
সংস্কৃত ভাষায় ঈ বর্ণটির উচ্চারণ ই-এর চেয়ে দীর্ঘতর কিন্তু বাংলা ভাষায় স্বরবর্ণদুটির উচ্চারণ অভিন্ন তাই বর্ণমালায় ৭টি মৌলিক স্বরধ্বনি জ্ঞাপক ৭টি মৌলিক স্বরবর্ণ রাখাটাই উত্তম যদিও অ্যা ধ্বনিজ্ঞাপক কোন স্বরবর্ণ বাংলা বর্ণমালায় নেই উপরন্তু একই উচ্চারণের জন্য ই, ঈ এবং উ, ঊ অর্থাৎ দুটি করে স্বরধ্বনি এবং ঐ, ঔ ইত্যাদি যৌগিক স্বরধ্বনি বিদ্যমান যেখানে উচ্চারণ বা শ্বাসাঘাত নির্ভর আরবি, স্প্যানিশ বা জার্মান ভাষায় একাধিক উচ্চারণ নির্দেশের জন্যও একই বর্ণের উপর ফোঁটা বা দাগ ব্যবহার করা হয় তাই বর্ণমালাকে অহেতুক ভার বহনের হাত থেকে মুক্ত করতে একটি ধ্বনির জন্য যেকোন একটি এবং অ্যা ধ্বনির জন্য একটি নতুন (সম্ভব হলে) বর্ণ নিশ্চিত করা উচিৎ আর এটি করতে গেলে বাদ দেওয়া বর্ণটির ব্যবহার আগে লোপ করতেই হবে তাতে বানান ভুলের সংখ্যাও কমবে
৫। বাংলা ভাষার অভিভাবকসম প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমির প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম পরিমার্জিত সংস্করণ ২০১২ (পুনর্মুদ্রণ ২০১৫)-এর অতৎসম শব্দ অংশের ২.১ নিয়ম অনুযায়ী আমাদের উপজেলার নামের
বানান ই-কার দিয়ে লেখাই যুক্তিযুক্ত। যেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানান নীতি প্রনয়ণের পর স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিজেদের অভ্যস্ততা ভেঙ্গে অভিন্ন নিয়মে বানান লিখেছেন সেখানে আমাদেরও তা মানতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

ভাষা নিয়ে প্রচণ্ড বিরোধিতাপূর্ণ মতামতের সংঘর্ষের কথা উঠলেই আমার মনে আসে বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রমথ চৌধুরীর সাধু-চলিত দ্বন্দ্বের কথা। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন সুস্থিত সাধুই হবে কথ্য ভাষার মানদণ্ড, সেখানে অপরিবর্তনশীলতার কারণে বিলুপ্ত হওয়া এককালে শক্তিশালী ভাষা সংস্কৃত ও ল্যাটিনের উদাহরণ টেনে প্রমথ চৌধুরী পক্ষ নিয়েছেন চলিত ভাষার। শুধু ভাষা সংক্রান্ত চিন্তাধারার বৈপরিত্যের জন্য একে অপরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করেছিলেন এ দুই আত্মীয়। তবে কালের পরিক্রমায় প্রাকৃত যেমন টেক্কা মেরেছিল সংস্কৃতকে, ঠিক তেমনি সাধু ভাষাকে হটিয়ে চলিত ভাষা অধিকার করে নিয়েছিল লেখ্য ও কথ্য উভয় ভাষার দখল। তবে বিংশ শতাব্দীর চলিত বুলেট ট্রেন গতির এ পরিবর্তনশীল যুগে কতটা মানানসই সেটাও বর্তমানে খতিয়ে দেখার বিষয়। আর উপরের সমগুরুত্ব ও সমসংখ্যক যুক্তির ভিত্তিতেও যারা কোন পক্ষ বাছাই করার ক্ষেত্রে আমার মত সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন, তারা দয়া করে দেরি করুন এবং দেখুন সময় কাকে বাছাই করে নেয়!


শামীম আল মাহমুদ (শিমুল)
প্রতিষ্ঠাতা সদস্য
অভয়ারণ্য (Sanctuary)


শনিবার, ৩ মার্চ, ২০১৮

 আমরা বাঁচতে চাই
--------------------------------
বালির ট্রাক,মাটির ট্রাক/
রাস্তায় পুলিশের ঝাক/
আমরা কিছুই চাই না/
আমরা শুধু চাই/
আমরা যেন মরি না।
---------------
রাস্তায় ত্রিশূল,গাডীতে প্রেট্টল/
কার কত বড় ভূল /
আমরা বুঝতে চাইনা/
আমরা শুধু চাই/
আমরা যেন মরি না।
------------------
রাস্তায় খুঁড়াখুঁড়ি, অনেক কথার ফুল ঝুড়ি
থাম্বা ধরে নাডানাডি
আমরা শুনতে চাইনা/
আমরা শুধু চাই/
আমরা যেন মরি না।
--------------
গাড়ীগুলো আনফিট,আস্তিক নাস্তিক
জঙ্গীর উপর শত ধিক
আর শুনতে চাইনা
আমরা শুধু চাই/
আমরা যেন মরি না।
( জাফর ইকবাল স্যারকে উৎসর্গ করে......কিশোর জীবনে আপনা বই দিয়েই বই পড়া শুরু)
03/03/2018,,,, 10:pm

মঙ্গলবার, ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

পন্তি অথবা কর্মজীবনে একটি বিচ্ছেদের গল্প...........
রুপন্তি অথবা কর্মজীবনে একটি বিচ্ছেদের গল্প.........

খুব অল্প বয়সে, মাত্র ২০বছর ৮ মাস যখন বয়স, যোগদান করলাম একটা কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্টে। জয়পুরহাট কালাই এর প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায়। বয়সের তুলনায় বেশি অপরিপক্ব r বেশি আবেগী। তাই এত দূর আসায় ভ্রমনের আনন্দের চেয়ে বন্ধু বিরহে মন বেশি কাতর।মনে হচ্ছে এত ছোট বয়সে চাকরী না নিলেও হত। আগে থেকেই প্রজেক্ট ম্যানেজানের সাথে কথা বলা আছে। আমি নামলেই অফিস নাইট গার্ড বাবলু ভাই আমাকে বাকি সব দেখিয়ে দিবেন। ঠিকানা শুধু লেখা ছিল জয়পুরহাট কালাই। ভাল করে জানার জন্য এ্যাডমিন অফিসারকে ফোনডী কিন্তু আমি শুনলাম পরিচিত এক জায়গা মোকামতলা। অনেক উল্টা পথ ঘুরলাম তবু কানকে দোষ দিলাম না। ওর আর দুষ কি? ও কি কখনো মোলামগাডী নাম শুনছে? তাই পরিচিত শব্দ মোকামতলাকেই ভেবে নিয়েছে। কালাই নেমে মোলামগাডী পর্যন্ত যেতে অনেকটা পথ ভ্যান এ গেলাম। চারদিকে শুধু মাটির ঘর।মাটির দুতলা ঘরগুলো দেখে অবাক হলাম। উচু ঘর মাঝে বাস দিয়ে মাচা করা তার উপরে আলু-ধান-গম রাখে। মানুষও থাকে। মাটির তৈরী দেয়ালে সুন্দর করে রং দিয়ে আলপনা আঁকা।মাটির ঘর আর তার আলপনা যতটা আমাকে মুগ্ধ করল মাটির রাস্তাঘাট ততটা মুগ্ধ করল না। তাই মা যখন জানতে চাইল মাকে বললাম গ্রামটা খুবই গরিব।কিন্তু বাবলু ভাই সারাদিন আমাকে নিয়ে ঘুরাফেরা করার পর, মাছের বড়বড় মাথা খাওয়ানোর পর মাকে আবার ফোন করলাম।মাকে বললাম ওরা গরিব কিন্তু অনেক ভালো মানুষ।মা বলল মানুষ চেনা কঠিন, বাইরে গেছ ধীরে ধীরে চিনবা।সত্যি ধীরে ধীরে আমি মানুষ চিনলাম।কিন্তু মা যে সুরে বলেছিল তার থেকে ভিন্ন সুরে। দিন গেছে মানুষগুলোকে আরও আপন মনে হয়েছে। বাবলু ভাই আমাকে নিয়ে সারাদিন বাসা খুজলেন। অনেক ভালো ভালো বাসা পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু আমার পছন্দ হচ্ছে না। অবশেষে আমি যেটা পছন্দ করলাম সেটা বাবলু ভাইয়ের পছন্দ না। কারন ঐ বাসাটা ফাকা।কেউ থাকে না।হাফ বিল্ডিং।মানে ইটের দেয়াল টিনের চালা।বাসায় ডিসের লাইন নেই,পানি তুলার মটর নেই,চুরের উৎপাত,পাশে জমিতে পানি দেওয়ার মেশিন চলবে,রাতে পিছনে এলাকার লোকজন তাস খেলবে।কিন্তু আমি এটাতেই উঠলাম কারন এমন ফাঁকা একটা বাসাই আমি খুজছিলাম। আমি একা থাকতে চাই।
বাসায় ডিসের লাইন আনলাম,পানি তুলতে মটর বসালাম,বাইরে বাতি জ্বালিয়ে রাখলাম ফলে চুর আর তাস খেলোয়াররা কায়দা করতে পারল না।কিন্তু আমার আর একা থাকা হল না।কারন মানুষ ভালবাসা আর ভালো বাসার কাঙ্গাল। প্রথমে একটা পরিবার উঠল। কিন্তু আমার তেমন সমস্যা হল না। কারন দিনের বেলায় আমি প্রায় একাই থাকতাম। উনারা দুজনেই বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকত। কিছুদিন ভালই যাচ্ছিল কিন্তু আমার যে সব কিছু ভাল যায় না।এখানেই তার ব্যতিক্রম হবে কেন?
হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই বাডির মালিক তার মেয়ে নাতনী নিয়ে হাজির। অবশ্য বাডির মালিক আমাকে জানিয়ে তার নিজের বাডিতে আসবে এমনটা আশা করিই ba কেমনে? সবাইকেই বিরক্তি লাগত কিন্তু বাসা মালিকের নাতনীর জ্বালাতনটা আরো বেশি, অসহ্য।তার জ্বালাতনের ধরণ একেক দিন একেক রকম। কোনিদন সে তার ছোট ছোট পাতিলে ধুলা বালি আর ঘাস লতাপাতা দিয়ে ভাত তরকারি রান্না করবে আর তা খেতে হবে আমাকে।কোনদিন সে কোন গাছে একটা ফুল দেখে এসে বায়না ধরবে তা এনে দিতে হবে।আমি ঘুমাব আর সে আমার রুমে টিভিতে কার্টুন দেখবে।মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে মনে হত বাসায় যাব না। কিন্তু বাইরেও থাকা হয় কম। বাজারে শুধু মামুন ভাইয়ের দোকানেই বসি তাও খুব অল্প সময়ের জন্য। প্রথম দিকে অন্য কাউকে চিনতাম ও না তাই বাধ্য হয়েই বিরক্তিগুলো সহ্য করা শুরু করলাম। তাছাড় ছোটদের আমি অনেক পছন্দ করি।বিশেষ করে তাদের সরলতাকে আমার ভাল লাগে।যা বুঝাব তাই বুঝবে এমন টাইপের পিচ্চিদের। যেমন কোন পিচ্চি বাদাম খাচ্ছে তার সামনে গিয়ে বাদামের সাথে শুকনো গাছ সহ বাদাম দেখিয়ে বলব দেখ ,এই বাদামগুলো খেও না।খেলে পেটে গাছ হবে।তার চেয়ে আমাকে দিয়ে দাও, আমি রোপন করি। গাছ হলে অনেক বাদাম হবে তখন আমরা মজা করে অনেক গুলো বাদাম খেতে পারব। আর সে সহজ সরল ভাবে দিয়ে দিবে। অথবা কোন পিচ্চির সাথে বাদাম খাচ্চি ইচ্ছে করেই কিছু বাদাম, বাদামের খোসার ভিতর ফেলে দিব পিচ্চি বুঝতেও পারবে না। পরে সেগুলো আলাদা করে আমি খাব।কিন্তু আমার বাসার এই পিচ্ছি আমার চেয়েও চালাক।কেমন চালাক তার নমুনা দেই। আমি একটা জাদু জানি। সিগারেট পুড়িয়ে তা থেকে টাকা বের করা। যা আমি কয়েকজন কে দেখিয়ে ভালই সুনাম অর্জন করেছি। এই পিচ্চি কার কাছ থেকে শুনছে আমি জানি না। শনিবার আমার অফিস বন্ধ। দুপুরে খেয়ে ঘুমাবো এমন সময় আপদটা এসে হাজির।তার একটাই বায়না সে জাদু দেখবেই। কতক্ষন না না করে যখন বুঝলাম কোন কাজ হবে না এর চেয়ে বরং জাদু দেখিয়ে বিদায় করাই ভালো তখন উঠলাম। এই জাদু দেখানোর জন্য আমি আগেই কিছু সিগারেটের ভিতর থেকে তামাক বের করে টাকা সুন্দর করে গোল করে পেঁচিয়ে সিগারেটে ভরে রেখেছি। যখন দেখাই তখন সেখান থেকে সিগারেট নেই। এই আপদটাকে বিদায় করতেও আমি যথারিতি তাই করলাম। আগুন ধরিয়ে কিছুটা পুরিয়ে হাতের মুঠোয় নিয়ে কিছুক্ষন হাত কচলিয়ে সিগারেটের ভিতর থেকে টাকা বের করে দেখালাম।ও মনোযোগ দিয়ে দেখল।জাদু শেষ হওয়ার পর আমি বললাম এবার আমি ঘুমাব তুমি যাও। ওর এক কথা তুমি ঘুমাও আমি পরে যাব।বিরক্ত হয়ে আমি পাশ ফিরে ঘুমালাম।কতক্ষন ঘুমালাম জানিনা তবে ঘুম যে পরিপূর্ণ হয়নি তা বুঝতে পারলাম। কারন এমন ডেন্জারাস একটা পিচ্চি পাশে রেখে নিশ্চিন্তে পরিপূর্ণ ঘুম হয়না।
আমি উঠেই পিচ্চিটার খোজ করলাম। তারপর আমার সিগারেটের খোজ নিলাম। দুইটাই লাপাত্তা। আমি জানি ওকে কোথাকোথা পাওয়া যেতে পারে।কিন্তু সেখানে সে নাই। তার খেলাধুলা করার সমস্ত হাডিপাতিল পরে আছে আর পরে আছে আমার খেলা দেখানোর তামাক ছাড়া সিগারেটের ছেড়া ছেড়া অংশ। তবে মাত্র কয়েকটা তাই আমি বাকিগুলো রক্ষা করতে খুজতে লাগলাম। অনেক কষ্টে তাকে খুজে পেলাম। অনেকগুলো পিচ্চির মাঝে দারিয়ে আছে। দুর হতে ভাবলাম হয়ত ও জাদু দেখাচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখি ওরে বাবা রিতিমত মাস্টারনি ভূমিকায় সে অন্য পিচ্চিদের সিগারেট দিয়ে কীভাবে টাকা বানাতে হয় তাই শিখাচ্ছে।
এরপর কয়েকটা দিন পিচ্চিটাকে দেখলেই রাগ হচ্ছিল। টাকা আর সিগারেট গুলো নষ্ট হয়েছে এই জন্য নয় রাগ হচ্ছিল আমার জাদুর ঘোমর ফাস করে দেওয়ায়। আমার জাদু এখন পাঁচ-সাত বছরের শিশুরাও পারে পার্থক্য শুধু আমার মত এত সুন্দর করে সিগারেট এ টাকা ভরতে পারেনা। অশব্য তাতে আরেক সমস্যা সিগারেটে টাকা ভরে দেওয়ার বায়না মিটাতে হয় যখন তখন
ও বড হয়েছে ঢাকায় তাই গ্রাম আর ঢাকায় বড় হওয়া দুটি শিশুর কত পার্থক্য হয় ওকে দেখে আমি বুঝেছি। এই বয়সেই ফটাফট ইংরেজি বলে। পোশাকেও আধুনিকতার ছোয়া। লেখাপড়া আঁকাআঁকি গান নাচ কি পায় না ও। ও এত কিছু পারার মাঝে আর যা বেশি পারে তা হল মানুষকে বিরক্ত করা।কোন কিছু ভুল করলে সেটা বলে সারাবাড়ি মাথায় নেওয়া। সবাইকে বলে সবার সামনে লজ্জায় ফেলা। আমি দেখতে না চাইলেও জুর করে ওর আঁকানো খাতা দেখানো। ওর মুখস্থ সব কবিতা ভাল না লাগলেও জুর করে শুনা।
এত এত বিরক্তিকর মাঝে আরও যেটা বিরক্তিকর ছিল সেটা হচ্ছে আমি অগোছালো আর এটা নিয়ে ওর ভালো না লাগার কথা শুনা।আংকেল তুমি এত অগুছালো কেন? রুমে ডুকে এইটাই ছিল তার প্রথম কথা।মনে হয় আমি যেমন ওর প্রতি বিরক্ত আমার অগোছালো কাপড়চোপড় দেখে ও আমার প্রতি তার চেয়ে বেশি বিরক্ত। মাঝে দেখতাম টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খাতা কলম বই এটা সেটা ও নিজেই গুছিয়ে রাখছে। ওর এটাও বিরক্তিকর কারন পরে দরকারের সময় আমি আর এগুলো খুজে পেতাম না । একদিন দুপুরে ঘুমাব ও এসে জ্বলাতন করতে লাগল।আগের রাতে ভালো ঘুম হয়নি।দিনেও ঘুম হচ্ছে না।তারমাঝে ওকে কেমন যেন মুটেই সহ্য হচ্ছিল না।তাই জুরে কঠিন সুরে চলে যেতে বললাম।ও যে এত সহজে কাদবে আমি বুঝতে পারিনি।ও কোন কথা না বলে নিঃশব্দে চোখে পানি এনে ফোপিয়ে ফোপিয়ে কেদে চলে গেল।আমি সারাটা বিকেল শুয়ে রইলাম কিন্তু ঘুম এল না।শুধু মনে হল কাজটা ঠিক হইনি।এত ছোট একটা পিচচি কে এবাবে কষ্ট দেওয়া ঠিক হলনা।আবার ভয় হল ওর মা বা নানীকে কিছু বলল কিনা।আমি সন্ধ্যায় বের হলাম আশেপাশে খুজলাম কিন্তু পেলাম না।পরদিন সকালে অফিসে যাওয়ার আগেও ওকে পেলাম না।অফিস থেকে এসেও পেলাম না।কেমন যেন ওকে খুজে পাওয়ার ইচ্ছা আমাকে জেকে ধরল।মনে হচ্ছে খুজে পেতেই হবে।তাই সব দ্বিধা বাদ দিয়ে ওর মার কাছে জানতে চাইলাম রুপন্তি কই।ও বলাই হয়নি পিচ্চিটার নাম রুপন্তি।তবে ওর মা ওকে রুপ বলে ডাকে।
ওর মা বলল ও তো ঘরেই।আমি বুঝলাম ও এত কষ্ট পেয়েছে যে ঘরেও আর জুরে কথা বলে না। আমি ধীরে ধীরে ওর রুমে ডুকলাম।দেখি ও ছবি আকাচ্ছে আমি যেতেই ছবি আকানো বাদ দিয়ে সব গুছাতে শুরু করল।আমি বললাম কি আকালে আমাকে দেখাবেনা? ওর কোন কথা নাই।আমি আরো অনেক কিছু বললাম কিছুতেই ও কথা বলে না পরে যখন বললাম ঠিক আছে তুমি যেহেতু আমার সাথে কথা বলবে না আমি তাহলে তোমাদের বাসায় আর থাকব না।বলে চলে আসব এমন সসময় ও তাহলে সরি বল।
ধীরেধীরে রুপন্তি কে আমার ভাল লাগতে শুরু করে।এখন আর ওর ধুলাবালির রান্না খেতে আমার আর বিরক্ত লাগে না।আমি বরং ওর কাছে চেয়ে চেয়ে দাওয়াত নেই।ও বলে এর পর দাওয়াত খেতে আসলে খালি হাতে আসা যাবেনা।মিষ্টি আনতে হবে। টিভিতে ওর কার্টুন দেখা আমার খারাপ লাগেনা।আমি অবাক হয়ে লক্ষ করি আমিও টম & জেরীর ভক্ত হয়ে গেছি।টম আর জেরীর দুষ্টামি দেখে রুপন্তির সাথে হাসতে হাসতে ওর গায়ে লুটিয়ে পডি। মাঝেমাঝে খেলা দেখা বাদ দিয়ে ওর জন্য আমি কার্টুন দেখি যা আমার ক্ষেত্রে ভাবা যায় না।যে আমি দুনিয়া উল্টে গেলেও খেলা দেখা মিস করি না সেই আমি শুধু মাত্র রুপন্তিকে খুশি রাখতে খেলা দেখা বাদ দিয়ে কার্টুন দেখি। মাঝেমাঝে বাজার থেকে চানাচুর বিস্কিট চকলেট এনে ওকে দেই।ওর মা বা নানী জানতে চাইলে বলি অফিস থেকে দিয়েছিল।আমি খাইনা তাই। জানি না কেন এতটা ভালবেসে ফেলি পিচ্চিটাকে।হয়ত আমার কোন ছোট বোন নাই অথবা ছোটদের ভালবাসলেও তাদের এতটা কাছাকাছি এই পথম তাই।অনেক আনন্দে কাটছিল দিন গুলো।সারাদিন অফিসের শেষেই সোজা চলে আসতাম বাসায়।এসেই রুপন্তিকে খোজ করতাম।কোনদিন না পেলে মনটা খারাপ হয়ে যেত কাউকে বুঝতে দিতাম না।অথচ এই রুপন্তিকেই আমি হারালাম।হঠাৎ একদিন অফিস থেকে এসে দেখি ওরা ওদের কাপড় চোপড় ব্যাগ পত্তর গোচাচ্ছে।আমি বুঝতে না পেরে রুপন্তিকে ডাকলাম।রুপন্তি জানাল ওরা আগামীকাল আবার ঢাকা চলে যাচ্ছে।আমি সঙ্গেসঙ্গে জানতে চাইলাম কবে আসবে।ও যা বলল তাতে হতাস হলাম।মাস খানেক পর আসবে।রুপন্তি চলে যাওয়ার পর আবার সেই একা হয়ে গেলাম।যে একাকে আমি ভালবাসতাম।যে একা থাকতে আমি এমন ভুতুরে বাড়ী ভাড়া নিয়েছিলাম সেই একাটাই এখন আমি সহ্য করতে পারিনা।আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।মাঝে মাঝে ওর রান্না করার জায়গাটা তাকিয়ে দেখি।ওখানে বসি। মাঝে মাঝে একা একা কার্টুন দেখি আর ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাই কবে মাসটা পারি হবে কিন্তু মাস আর পারি হয়না বরং আমার বদলীর নোটিশ আসে।আমি চলে আসি দিনাজপুরে।